প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। ওই লক্ষ্যে সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠান সক্রিয়। ওসব প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ অবস্থানে কাজ করছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মাঠপর্যায়ে, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ব্যাংকিং চ্যানেলে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দেশে হুন্ডি বন্ধে কাজ করছে।
মূলত হুন্ডি বন্ধ করে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতেই ওসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। হুন্ডির সঙ্গে বড় চক্র জড়িত। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। এদিকে হুন্ডি ঠেকাতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে সরাসরি রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন এ উদ্যোগ কার্যকর হলে দেশের মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির অ্যাপস ব্যবহার করে বিদেশে বসে অর্থ পাঠাতে পারবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সেবা অনেক আগেই চালু করা দরকার ছিল। আর প্রবাসীরা বলেছেন- বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো ও গ্রহণ প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে। একই সঙ্গে ডলারের বিনিময় মূল্যও বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার দাবি জানান তারা।
অন্যদিকে মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন (হুন্ডি) করছে একাধিক চক্র। এমন একটি চক্র এমএফএস ব্যবহার করে চার মাসে ৩ কোটি টাকা হুন্ডি করেছে। এমন চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইনান্সিয়াল ক্রাইম এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিট। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন— মীর মো. কামরুল হাসান শিশির (২৮), খোরশেদ আলম (৩৪), মো. ইব্রাহিম খলিল (৩৪), কাজী শাহ নেওয়াজ (৪৬), মো. আজিজুল হক তালুকদার (৪২) ও মো. নিজাম উদ্দিন (৩৫)। সোমবার রাতে কুমিল্লা ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়ে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচার ও বিদেশে অবস্থানরত ওয়েজ আর্নারদের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে না এনে স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ করার মাধ্যমে অর্থপাচার করে আসছে। এমএফএসের দুই হাজার এজেন্ট সিমের মাধ্যমে প্রতি মাসে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রবাসীদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈধ পথে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা অনেক আগেই চালু করা উচিত ছিল। হুন্ডি ঠেকাতে যত দ্রুত সম্ভব মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স গ্রহণের অনুমতি দিতে হবে। ব্যাংকে টাকা পাঠাতে অনেক সমস্যা। খরচ বেশি। তাই মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোকে রেমিট্যান্স সংগ্রহের দায়িত্ব দেয়া সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, কাতার, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে হুন্ডির মাধ্যমে বা অবৈধ পথে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা দেশে আসে। এই পরিমাণ অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে বা বৈধ পথে আনা গেলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। চলমান ডলার সংকটের কারণে যেসব বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা কেটে যাবে।
এদিকে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আনার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক এই সেবা চালু করার অনুমতি দিলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা সহজেই দেশে প্রিয়জনের কাছে অর্থ পাঠাতে পারবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনদের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা অথবা ডিলারের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করবে। রেমিট্যান্সের অর্থ প্রবাসীদের দেয়া বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে জমা হবে। মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নিজেরা সংগ্রহ করবে, নাকি ডিলারের মাধ্যমে করা হবে, সে বিষয়গুলো চূড়ান্ত হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদেশে খাবার হোটেল, সুপারশপ, মুদিদোকানে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বিকাশ, রকেটের মাধ্যমে পাঠানোর জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন হুন্ডি কারবারিরা। বিদেশ থেকে ডলার নিয়ে দেশে প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনের বিকাশ, রকেট ও নগদ নম্বরে টাকা জমা দেন হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। অনেক সময় প্রবাসীদের বাসা থেকে ডলার সংগ্রহ করে দেশে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে টাকা। ফলে প্রবাসী আয়ের অনেক ডলার দেশে আসছে না।
এসব কিছু বিশ্লেষণ করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলমান ডলার সংকটের বিষয়টি সামনে রেখে যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থা করতে চায়।
এ জন্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ, রকেট, উপায়, নগদসহ সব অপারেটরের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
এদিকে বৈধ পথে বা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো আরও সহজ করার দাবি জানিয়েছেন প্রবাসীরা। সিঙ্গাপুরে কর্মরত মো. রেজাউর রহমান শামীম বলেন, ‘প্রবাসীরা সব সময় ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে চান। এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোতে যাওয়ার পর যে পরিমাণ কাগজপত্রে সই করতে হয়, এতে একবার এক্সচেঞ্জ হাউসে গেলে দ্বিতীয়বার আর কেউ যেতে চান না। একই সমস্যা দেশেও। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা তুলতে গেলে কোথা থেকে টাকা পাঠিয়েছেন, বিদেশে কী কাজ করেন, টাকা দিয়ে কী করবেন এ ধরনের বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আর হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য আমাদের কোথাও যেতে হয় না। শুধু ফোন করে বলার পর বাড়িতে টাকা পৌঁছে দিয়ে আসে।’
রেজাউর রহমান বলেন, বৈধ পথে বা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে হবে। হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানোর আরও একটি কারণ ডলারের রেট বেশি। ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে ৭-৮ টাকা বেশি দেন হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। তাই ডলারের বিনিময় হারও বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার দাবি জানান তিনি।
বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য ডলার রেট ১০৭ টাকা, সঙ্গে ২ দশমিক ৫ শতাংশ সরকারি প্রণোদনা। অন্যদিকে হুন্ডিতে ডলার রেট প্রায় ১১৪-১১৫ টাকা। যে কারণে প্রবাসীরা হুন্ডিতেই বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।
সরকারের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮৭ জন শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে গেছেন, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩২ জন। চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৯০ হাজার শ্রমিক কাজের জন্য বিদেশে গেছেন। প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও আগের মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে অক্টোবর মাসে।
অক্টোবরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ১৫২ কোটি ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ বা ১২ কোটি ডলার কম। সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছিলেন ১৬৪ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪.৩ বিলিয়ন ডলার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ গত বছরের জুলাই থেকে কমতে শুরু করে। তারপর প্রতি মাসেই গড়ে রেমিট্যান্স কমছে। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব ও দেশে বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় রিজার্ভ বাড়ানোর বিকল্প নেই। কারণ রপ্তানি আয় কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে শুধু রেমিট্যান্স বাড়াতে পারলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও রেমিট্যান্সে পাঠানোর ক্ষেত্রে হুন্ডি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই প্রেক্ষিতে বিএফআইইউ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের হুন্ডির ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। সেখানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও হুন্ডির তথ্য পাওয়া গেছে।
ইতোমধ্যে হন্ডিতে জড়িত ২ শতাধিক হিসাব সাময়িকভাবে জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি হুন্ডির সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের লাইসেন্স বাতিল করার প্রক্রিয়া চলছে। বিএফআইইউ থেকে ইতোমধ্যে হুন্ডির বিষয়ে সন্দেহভাজনদের একটি তালিকা গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেয়া হয়েছে। আর গোয়েন্দারা ওই বিষয়ে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করছে।