মেয়র আরিফের বিদায়, দায়িত্ব নিলেন আনোয়ারুজ্জামান

বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বভার গ্রহন করেছেন নবনির্বাচিত মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। পূর্ণ মেয়াদ শেষে সিলেট সিটি করপোরেশনের টানা দুই বারের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্বাচিত মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর কাছে দায়িত্বভার হস্তান্তর করেন।

মঙ্গলবার (৭ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে তিনটায় নগর ভবনের মেয়র কক্ষে এ দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠিত হয়। এসময় বিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নতুন মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী উভয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ঐতিহাসিক এই দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি, দুই মেয়রের পরিবারবর্গ এবং সুধিজন।

বিকেল চারটায় নগর ভবন প্রঙ্গনে দায়িত্ব হস্তান্তর উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশ যোগ দেন মেয়রদ্বয় এবং সিসিকের ৪২ ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর, সংরক্ষিত কাউন্সিলরগণ। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী ইমরান আহমদ এমপি বলেন, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বের পালাবদলের ইতিহাসে আজকের এই আয়োজনটি ঐতিহাসিক। বিদায়ী মেয়র সিলেটকে অনেক বদলে দিয়েছেন। রাস্তাঘাট প্রশস্ত করেছেন। অনেক উন্নয়ন করেছেন। তবুও সিলেট নগরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে আরো অনেক কাজ করতে হবে। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র প্রয়াত বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের উত্তরসূরি নয়া মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সিলেটকে উন্নত নগরে পরিণত করতে কাজ করবেন। সিলেটের উন্নয়নে সরকারের সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে, আগামীতেও থাকবে।

সুধি সমাবেশে সিসিক মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী কৃতজ্ঞতা জানান বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রধান, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি। কৃতজ্ঞতা জানান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি। গত সিলেট নগরবাসি ভোট দিয়ে মেয়র নির্বাচিত করায় সর্বস্থরের নাগরিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। সিলেটের প্রয়াত সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা আমৃত্যু সিলেটের উন্নয়নে কাজ করে গেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানান মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।

আওয়ামী লীগের দেশ ব্যাপি উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সিলেটকে একটি তিলোত্তমা নগরে রূপান্তরের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি আরো বলেন, সিলেটকে একটি আধুনিক, স্মার্ট সিটি হিসেবে রূপান্তরের রূপকল্প বাস্তবায়নে সিলেট নগরবাসির সহযোহিতা প্রয়োজন।

আধ্যাত্মিক ও পর্যটন নগর খ্যাত সিলেটের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা আরো বেগবান করতে সকলের সহযোগিতায় তার পরিষদ যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে। নগর উন্নয়নে বিদায়ি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সহযোগিতা কামনা করে তার সুযোগ্য নেতৃত্বে বিগত ১০ বছরে সিসিকের অগ্রযাত্রার প্রসংশা করেন। আগামী দিনে নগর উন্নয়নে সিলেটবাসির সহযোগিতাও কামনা করেন তিনি।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়নে আমি মেয়র নির্বাচিত হলেও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে আমি সিলেটবাসির মেয়র। নগর ভবন থাকবে রাজনীতি মুক্ত। নগরবাসি সবার জন্য নগর ভবন উন্মুক্ত থাকবে বলেও প্রতিশ্রতি ব্যক্ত করেন।

আরও পড়ুন : এসএমপির তিন পুলিশ কর্মকর্তার পদোন্নতি

সিসিকের বিদায়ি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সম্প্রতির নগরের সিলেটের নগর প্রতিষ্ঠান সিটি কর্পোরেশনের নব নির্বাচিত মেয়রের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পেরেছি। আমি কৃতজ্ঞ নগরবাসির কাছে। নগরবাসির নিকট আমি চির ঋনি থাকবো। আপনাদের ভালোবাসায় দুই মেয়াদ মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছি। সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে একটি জনবান্ধব নগর প্রতিষ্ঠায় নগরবাসির সহযোহিতা পেয়েছি। সিলেট সিটি কর্পোরেশন টানা ৪ অর্থবছরে কর্মসম্পাদন চুক্তির বাস্তবায়নে দেশ সেরা হয়েছে। নগরের সড়ক প্রসস্থকরণে সিলেটের নাগরিকরা হাজার হাজার কোটি টাকার নিজস্ব ভূমি দান করে দেশের ইতিহাসে বিরল এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। বিদায় বেলা আমি ভূমিদাতাগণ সহ সিলেটের উন্নয়নে যারা নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমার পরিষদের দুই মেয়াদে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের উর্ধ্বে উঠে নাগরিক সেবা ও উন্নয়ন কাজ করার সর্বাত্মক চেষ্ঠা করেছি। কাউন্সিলরদের সহযোগিতায় সিলেটের উন্নয়নে কখনো আপোষ করিনি। আজকের পর হয়তো আমি মেয়রের দায়িত্বে থাকছি না। আমি আপনাদেরই মানুষ। যে অবস্থানেই থাকি না কেন সিলেটের উন্নয়নে আপনাদের আরিফকে পাশে পাবেন। নতুন পরিষদের প্রয়োজনে সবধরণের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন বিদায়ি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। মেয়রের দায়িত্বে থাকাকালের নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নয়া মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে নগর পরিচালনায় কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দেন।

সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান, সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আব্দুল মহিত, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, স্বাধীনতার পর সিলেট পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবরুল হোসেন বাবুল, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান আ ফ ম কামাল, সিসিকের প্রথম মেয়র প্রয়াত বদর উদ্দিন আহমদ কামরান এর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানান বিদায়ি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান সিসিকে সকল কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারিদের।

অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনেরা বলেন, বিদায়ি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী তার মেয়াদে নগর ‍উন্নয়নে রাজনৈতিক বিরোধের উর্ধ্বে উঠে কাজ করেছেন বলে মন্তব্য করেন। সিলেটের উন্নয়ন প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। নয়া মেয়র আনোরুজ্জামান চৌধুরী সিলেটের রাজনৈতিক সৌহার্দ্য বজায় রেখে সিলেটকে স্মার্ট নগরে রূপান্তর করবেন।

অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানের শুরু হয় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, পবিত্র গীতা, পবিত্র ত্রিপিটিক ও পবিত্র বাইবেল পাঠ করার মধ্য দিয়ে। পরে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদগণ, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদগণ, জাতীয় ও সিলেটের প্রয়াত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সিলেট পৌরসভা এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত চেয়ারম্যান, মেয়র, কমিশনার, কাউন্সিলর এবং কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আত্মার শান্তি কামনা করে দাড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

রজত কান্তিগুপ্ত ও জান্নাতুল নাজনীন আশার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিসিকের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ফাহিমা ইয়াসমিন। পরে সিসিক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর উপর নির্মিত একটি ভিজ্যুায়াল প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করা হয় এবং ভিজ্যুায়াল প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সিসিকের ৪২ ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের পরিচিতি ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এমপি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হক, সহ বিশিষ্টজনদের ভিডি বার্তা উপস্থাপন করা হয়।

সুধি সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হক, সংসদ সদস্য হাফিজ আহমদ মজুমদার, সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক, সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট জেলা শাখার সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. নাসির উদ্দিন এ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সিলেট মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমেদ সিদ্দিকী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব নজরুল ইমলাম খান, সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. ইলিয়াছ শরিফ, সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান, সিলেট জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন, বিশিষ্ট শিল্পপতি ইকবাল আহমদ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক প্রমুখ।

এর আগে সিসিকের দায়িত্ব হস্তান্ত উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবে ঐদিন মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সহ নবনির্বাচিত কাউন্সিলরবৃন্দ বাদ জোহর হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার জিয়ারত করেন।

সুধি সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ, সিসিকের ৪২ ওয়ার্ডের সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরগণ, সিলেটের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ, সিলেটের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তর সংস্থার প্রতিনিধিগণ, নাগরিকবৃন্দ, সিসিকের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিকে সম্মাননা তুলেন দেন সিসিকের বিদায়ি মেয়র ও নব নির্বাচিত মেয়র। বিদায়ি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এবং মেয়র পত্নি হলি চৌধুরী বিদায়ি মেয়র পত্নি সামা হক চৌধুরীকে উপহার সামগ্রী প্রদান করেন।

সুধি সমাবেশ শেষে বিদায়ি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে নব নির্বাচিত মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী সহ সিসিকের সকল কাউন্সিলর, সংরক্ষিত কাউন্সিলরগণ, সিসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ তাঁর কুমারপাড়াস্থ বাসভবনে র‌্যালি করে পৌছে দেন।

প্রসঙ্গত, গত ২১ জুন অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি করপোরেশনের পঞ্চম নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১টি ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, টানা দুইবারের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা ঘোষণা করেননি।