ভাষা সংগ্রামী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণ সভায় বক্তারা বলেছেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর মেধা মনন এবং সৃজনকর্মের জন্য তিনি ছিলেন পৃথিবীর আলোকিত মানুষ। তিনি সাদাকে সাদা, কালো কালো বলতেন। তিনি ছিলেন সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে একজন বিশ্বনাগরিক।
রবিবার (১৪ মে) বিকেলে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের শহীদ সোলেমান হলে অনুষ্ঠিত স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করেন সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যারিস্টার মো. আরশ আলী। সংগঠনের সদস্য সচিব আহমেদ নূরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়ি, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রয়াতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। আলোচনা পর্বে ‘বহুমাত্রিক আবুল মাল আবদুল মুহিত’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট লেখক, অনুবাদক ও টেগোর সেন্টারের প্রধান নির্বাহী মিহিরকান্তি চৌধুরী। প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন শিক্ষাবিদ ডক্টর আবুল ফতেহ ফাত্তাহ।
অনুষ্ঠানে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন এক কর্মঠ দেশপ্রেমিক। ছিলেন সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে একজন বিশ্বনাগরিক। তাঁর মৃত্যুর আগে গুণিশ্রেষ্ঠ হিসেবে গণসংবর্ধনা দিতে পেরে সিলেটবাসী ধন্য। কিন্তু আমরা রাজনীতিবিদরা কি তাঁকে যথাযথ সম্মান দিতে পেরেছি? পারিনি। আমরা তাঁর আদর্শ লালন করে তাঁকে সম্মান জানাতে পারি।’
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতেন। তাঁর প্রতি আস্তা ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনার। তিনি প্রচলিত রাজনীতিবিদ না—হয়েও কীভাবে মাঠপর্যায়ে রাজনীতি করতে হয়, তা জানতেন। নেতাকর্মীদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতেন। তিনি আঞ্চলিকতাকে পরিহার করেও সিলেটের উন্নয়ন করেছেন। এই মহান ব্যক্তির জীবন ও কর্ম নিয়ে এই ছোট্ট পরিসরে আলোচনা করা সম্ভবপর নয়।’
তিনি বলেন, তাঁর মেধা মনন এবং সৃজন কর্মের জন্য তিনি ছিলেন পৃথিবীর আলোকিত মানুষ।
শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল আরও বলেন, ‘তিনি (মুহিত) লেখালেখি, গবেষণা ও পরিবেশ আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকলে আমরা সংস্পর্শ পেতাম না। অনেক কিছু শিখতে পারতাম না। বরুণ রায়, পীর হবিবুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত; আমরা যদি এসব গুণীদের চর্চা করি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সমৃদ্ধ হবে।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আজিজুস সামাদ আজাদ ডন বলেন, ‘যখনই আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে যেতাম, সময় দিতেন। আমি তাঁকে চিনি গবেষক হিসেবে। তাঁর হাতে সবসময়েই বই থাকতো এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় আমিও লেখালেখি করি।’
জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘মুহিত ছিলেন ক্ষণজন্মা। মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন। তিনি একটি নির্বাচনে হেরে গেলেও সিলেট ত্যাগ করেননি। মানুষের পাশে ছিলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন। আমি বলব, মৃত্যুর পরেও তিনি আমাদের মাঝে আছেন। থাকবেন।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘তাঁর পরিকল্পনার ধারাবাহিক ফল পাচ্ছি আমরা। সৎ এবং কর্মঠ ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অবদান ছিল অনন্য। তাঁর বিকল্প কেউ হবে না। তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে গ্রন্থ বের হোক।’
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, ‘ভাষাসৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি বিরল সৌভাগ্যবান। ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তাঁকে আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে দেখেছি, ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও দেখেছি। তাঁকে আমরা অন্যমাত্রার আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসেবে দেখেছি। এমন মানুষ আর পাবো না।’
সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ বলেন, ‘প্রতিবছর যদি তাঁকে নিয়ে এইরকম ছোটো ছোটো সংকলন বের করা হয়, তাহলে তাঁর বর্ণাঢ্যজীবন সম্পর্কে আমরা জানতে পারব।’
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত শেখ হাসিনা সরকারের অগ্রণী পুরুষ ছিলেন। সরলমানুষ ছিলেন। যা বিশ্বাস করতেন, তাই স্পষ্টভাবে বলতেন। তিনি সিলেটি হয়েও আন্তর্জাতিক ছিলেন। পদ্মাসেতু তাঁর সাহসের ফসল। প্রজ্ঞার ফসল। সিলেটের শুধু নয়, দেশের ব্যাপক উন্নয়নে তাঁর অবদান চির স্মরণীয়।’
মূল প্রবন্ধে মিহিরকান্তি চৌধুরী বলেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের হাতেগোনা ব্যক্তিদের একজন যিনি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতেন অনায়াসে। তিনি যে নির্ভীক ছিলেন তা অনেকের জন্য ভয়ের কারণ ছিল। তাঁর মেধা, মনন ও ব্যক্তিত্বের সঠিক বিকাশ সঠিক সময়ে হয়েছে বলেই তাঁর এই দুর্দান্ত প্রকাশ সম্ভবপর হয়েছিল। বর্তমান বাংলাদেশে বিকাশের আগেই প্রকাশ স্থান করে নিয়েছে। বলা যায়, উগ্র প্রকাশের কবলে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশ। অনেক সময় যেন রিকটার স্কেলও কেঁপে ওঠে, ফাটল ধরে বৃহৎ স্থাপনায়, জরাজীর্ণ ভবন আরও বুড়িয়ে যায়, নদী মানে না শাসন। আমাদের আশা, আবুল মাল আবদুল মুহিতের বর্ণাঢ্য জীবনের দর্শন নতুন প্রজন্মকে বিকাশমুখী করে তুলবে। উগ্র প্রকাশভাবনা সৃজনশীল বিকাশভাবনার কাছে পরাভূত হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাপ্নিক এ মানুষটি ছিলেন আমাদের সমাজের প্রাগ্রসর এক ব্যক্তি। বহুমুখী বিরল প্রতিভার অধিকারী সিলেটের এই কৃতী সন্তান যেমন সিলেটের প্রতিটি প্রয়োজনে ভূমিকা রেখেছেন, তেমনই দেশের প্রয়োজনে তাঁর কর্মকৌশল ও মেধাবলে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ ও সিলেটের গৌরব বাড়িয়েছেন।’
মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় শিক্ষাবিদ ডক্টর আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বলেন, ‘তাঁর রাগের মধ্যে সংস্কৃতি ছিল, তাঁর কলহাস্যে ছিল সংস্কৃতি। তাঁর সারল্য এবং মেধাপ্রজ্ঞা ছিল প্রবাদপ্রতিম। তাঁর রচনা পঠনপাঠনের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করব।’
স্মরণসভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন, সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাহি উদ্দিন আহমদ সেলিম, সহ—সভাপতি ও রাজনীতিবিদ বিজিত চৌধুরী, সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি আবদুল জব্বার জলিল, অ্যাডভোকেট মো. রাজউদ্দিন, কবি এ কে শেরাম, কবি নাসিমা চৌধুরী, সম্মিলিত নাট্যপরিষদের সভাপতি রজতকান্তি গুপ্ত প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে ব্যারিস্টার আরশ আলী বলেন, ব্যক্তি আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি প্রতিষ্ঠানে নিজেকে রূপান্তর করেন। পারিবারিক শিক্ষা পরিবেশ তাঁর সুখ্যাতির পেছনে কাজ করেছে। তিনি দেশপ্রেমিক এবং আজীবন মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন।