মহান মুক্তিযুদ্ধে ৫ নং সেক্টরের সর্বকনিষ্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু হত্যাকাণ্ডের ২৬ বছর পর মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালতের দেয়া পর্যবেক্ষণের আলোকে মামলাটি অধিকতর তদন্ত করতে র্যাবকে নির্দেশ দেয়া হয়।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত দায়রা জজ (১ম) আদালতের বিচারক মহিউদ্দিন মুরাদ সম্প্রতি এই আদেশ দেন।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পিপি এডভোকেট সোহেল আহমদ এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু চৌধুরীকে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এটি দেশব্যাপী আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তারা মামলার যথাযথ তদন্ত করেননি। যে কারণে বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হয়েছে। আসামিদের রক্ষার জন্যে তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রাণপণ চেষ্টাও করেছেন। আদালতের নিকট মামলার আদ্যোপান্ত ত্রুটি ও প্রশ্নবিদ্ধের বিষয়টি ধরা পড়ায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয় র্যাবকে। এজন্যে আদালত সুনির্দিষ্টভাবে কিছু পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন। আদালতের দেয়া পর্যবেক্ষণের আলোকেই বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করতে হবে। আসামি পক্ষের আইনজীবী কামাল উদ্দিনও পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ তদন্তের কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘মূল হোতাদের রক্ষা করতে তদন্ত কর্মকর্তারা তাদের মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। আদালতের কাছেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। আমরা চাই, প্রকৃত আসামিদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হোক। যেসকল কর্মকর্তা তদন্তের নামে প্রহসন করেছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হলেও দীর্ঘ সাড়ে ৪ বছরেও আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়নি। এরই মধ্যে আদালতের নিকট মামলার তদন্তে নানা অসঙ্গতি, ত্রুটি ধরা পড়ে। এর প্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত দায়রা জজ (১ম আদালত) মহিউদ্দিন মুরাদ গত ১৩ নভেম্বর মামলাটি অধিকতর তদন্ত করতে এলিট ফোর্স র্যাবকে আদেশ দেন।
আদালতের দেয়া আদেশে বলা হয়, ‘মামলার এজাহার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির সরকার নিজ হাতে লিপিবদ্ধ করেছেন। উক্ত এজাহারেই বাচ্চু চৌধুরীর বিষয়ে কুৎসা রটানো হয়েছে যে, তিনি একজন প্রভাবশালী লোক এবং গাদিয়ালা জলমহালে মাছ ধরতে হলে তাকে বিশাল অংকের ভাগ দিতে হয়। মামলার সংবাদদাতা (বাদী) হলেন, বাচ্চু চৌধুরীর আপন বড় ভাই। আপন বড় ভাই নিজের ছোট ভাইয়ের মৃত্যু সংক্রান্ত এজাহারে মৃত ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করবেন এই বিষয়টি বাস্তবতার বিপরীত।’
এর আগে জগন্নাথপুর থানার তৎকালীন ওসি হুমায়ুন কবির সরকার ও সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম মজুমদার তদন্ত শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধি আইনের ১৪৭/১৪৮/১৪৯/৩০২/১০৯ ধারায় অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগপত্র নং ৩৬।
অভিযোগপত্র দেয়ার পর এ পর্যন্ত মামলার আসামিদের মধ্যে, সরদার উল্লা, জালাল মিয়া, করম আলী, ওয়াজিদ উল্লা, আব্দুল হাসিম, রফিক ও সোনা মিয়া মারা গেছেন। এছাড়া মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলী, রিপন ও শাহীন মিয়া দীর্ঘদিন ধরে পলাতক রয়েছে। মূল ঘাতক লিয়াকতের অবস্থানের ব্যাপারে আজও আইন শৃংখলা বাহিনীর নিকট কোনো তথ্য নেই।
১৯৯৬ সালের ৭ জানুয়ারি সকাল প্রায় সাড়ে ১০ টায় জগন্নাথপুর উপজেলার গাদিয়ালা নদীর পশ্চিম পাড়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চুকে (৪২) কুপিয়ে হত্যা করে। নিহত বাচ্চু চৌধুরী পার্শ্ববর্তী বেতাউকা গ্রামের আব্দুল ওয়াহিদ চৌধুরীর ২য় পুত্র। তখনকার অত্যন্ত প্রভাবশালী ও সাহসী রাজনীতিক বীর মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু চৌধুরীকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়। নিজ বাড়ীর অদূরে এভাবে খুন হবেন তিনি তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই আব্দুল মুকিত চৌধুরী লেবু মিয়া বাদী হয়ে পরদিন ২৮ জনের নাম উল্লেখ করে জগন্নাথপুর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহার জগন্নাথপুর থানার তৎকালীন ওসি হুমায়ুন কবির সরকার নিজ হাতে লিখে দিয়েছিলেন। মামলা নং ১।
এজাহারে বলা হয়, লিয়াকত আলী, আব্দুল হক, রিপন, জালাল, ছাদ আলী, আব্দুল কাইয়ুমসহ আরো ৫-৬ জন মিলে দৌড়ে এনে ঘটনাস্থলে বাচ্চু চৌধুরীকে ঘিরে ফেলে। এ সময় তারা এলোপাতাড়ি কুপিয়ে বাচ্চু চৌধুরীকে হত্যা করে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৫নং সেক্টরের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু। জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লাসহ অনেক এলাকায় দাস পার্টির (মুক্তিযুদ্ধকালীন বৃহত্তর হাওর এলাকার বিশেষ দল) সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেন তিনি। অদম্য সাহসী বাচ্চু ছুটে যেতেন পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদরদের খোঁজে। তার অসীম সাহসের কথা এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে শোনা যায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ ‘দাস পার্টির খোঁজে’ গ্রন্থের লেখক হাসান মুরশেদ গ্রন্থটিতে লিখেছেন, দাস পার্টির প্রধান জগৎ জ্যোতি দাস শহীদ হবার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল হক চৌধুরী বাচ্চু দাস পার্টিকে কমান্ড করেন। তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ কমান্ডার। তিনি লাল বাহিনী নামের আরেকটি বাহিনীরও কমান্ডার ছিলেন। যুদ্ধকালীন তার অসীম সাহসে ভাটি বাংলায় অনেক ঘর-বাড়ি পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদরদের আগুন ও লুটপাট থেকে রক্ষা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। দু’বার জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অল্প ভোটে হেরে যান।
এছাড়াও তিনি জগন্নাথপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন। বর্তমান জগন্নাথপুর সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার অনন্য অবদান রয়েছে। এছাড়াও জগন্নাথপুর উপজেলা সদরের স্বরূপ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় ও জগন্নাথপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সরকারিকরণেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্যে স্থানীয় সরকারি খাদ্য গোদামের তালা ভেঙে দেন। বিষয়টি তৎকালীন সময়ে দেশব্যাপী আলোচিত হয়।