‘মিনিকেট’ নামে ভোক্তার পকেট কাটছে সুপারশপগুলো

‘মিনিকেট’ নামে কোনো ধান নেই। অথচ এ নামেই বাজারে চাল বিক্রি করে বেশি মূল্য নেওয়া হচ্ছে। কাটা হচ্ছে ভোক্তার পকেট। সরকারের কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকারও বলছে, মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। এটা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা।

আর যেসব প্রতিষ্ঠান মিনিকেট নাম দিয়ে চাল বিক্রি করছে তাদের প্রতিনিধিরাও বলছেন, মিনিকেট নামে ধান নেই। সরকার চাইলে এগুলো বন্ধ করে দিতে পারে। আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ও সুপারশপ ঘুরে দেখা গেছে, মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাত না থাকলেও সাধারণ ধান থেকে উৎপাদিত চালকে চিকন করে মিনিকেট নামে ‘সরু চাল’ রাজধানীসহ সারাদেশের বাজারে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। চাল উৎপাদনকারি বিভিন্ন মিলমালিকরা মিনিকেট নাম দিয়ে সেই চাল প্যাকেটজাত করে ৭০ থেকে ৮৪ টাকা কেজি দরে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করছে। এক্ষেত্রে এসিআইর ৫ কেজি মিনিকেট চাল বিভিন্ন সুপারশপে বিক্রি করা হচ্ছে ৩৪৮ টাকায়। ভোক্তাদের সেই চাল কিনতে হচ্ছে ৪২০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজি ৮৪ টাকা। ২০ শতাংশ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। একইভাবে প্রাণ ৫ কেজি চাল ৩৮৭ টাকা বিক্রি করছে, ভোক্তাদের তা কিনতে হচ্ছে ৪৪০ টাকায়। তীর ব্র্যান্ডের ৫ কেজির চাল ৩৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সুপারশপসহ বিভিন্ন মুদি দোকানে। ভোক্তাদের সেই চাল কিনতে হয় ৪১০ টাকায়।

এক্ষেত্রে আগোরা, মিনাবাজারসহ বিভিন্ন সুপারশপ ও বড় মুদি দোকানিরা লাভ করছেন ৫৫ টাকা বা ১৬ শতাংশ। এছাড়া চিনিগুড়া আতপ চাল, প্রাণ, চাষী কোম্পানির ৫ কেজির চাল ২১ শতাংশের বেশি দরে ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে। এর সঙ্গে সুপারশপের ভ্যাটও রয়েছে চার-পাঁচ শতাংশ। এভাবে ভোক্তাদের অজান্তেই প্যাকেটজাতের নামে ভোক্তাদের পকেট থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা করপোরেট কোম্পানিগুলোর কাছে চলে যাচ্ছে।

মিনিকেট চালের নামে বেশি দামে চাল বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে এসিআইর এজিএম (রাইস) মো. রুবেল পারভেজ বলেন, ‘সুপারশপে সরবরাহ করা চালের মূল্য আমাদের কোম্পানি থেকে নির্ধারণ করা হয়। কোয়ালিটি ভালো। তাই দামও বেশি। বাজারে ২৫ কেজি ও ৫০ কেজির যে চালের প্যাকেট বিক্রি করা হয় তার চেয়ে ভালো কোয়ালিটি ৫ কেজির মিনি প্যাকেটের। এ ছাড়া প্যাকেটিং খরচও প্রতি কেজিতে পাঁচ টাকা করে। সুপাশপের চাল বগুড়ার নন্দীগ্রামের বাজার থেকে বেশি দামে কেনা হয়। বোরো মৌসুমের ৮০ শতাংশ জিরাশাইল ধান থেকে এই মিনিকেট চাল করা হয়। অর্থাৎ মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে হলে এসিআইর বিজনেস ম্যানেজার মো. জহিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’

সিটি গ্রুপের তীর ব্রান্ডের ৫ কেজি প্যাকেটের ক্রয়মূল্য ৩৫৫ টাকা। সেই প্যাকেট ৪১০ টাকায় বিভিন্ন সুপারশপসহ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এটা বাজারের চেয়ে বেশি দাম কি না জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘ আমাদের করার কিছু নেই। ট্যারিফ কমিশনের বেঁধে দেওয়া দামেই এটা বিক্রি হচ্ছে। পরিবেশকদের ৩ টাকা ও খুচরা বিক্রেতাদের ৫ টাকা কমিশন দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্যাকেটের খরচও আছে। এই চালের কোয়ালিটি ভালো। তাই দামও বেশি।‘

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, অন্য ধান থেকে উৎপাদিত চালকে মিনিকেট নামে ব্র্যান্ড করে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। সরকার বা খাদ্য মন্ত্রণালয় চাইলে এটা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আর বেশি দামে ভোক্তাদের কিনতে হবে না।’

প্রাণ গ্রুপের ৫ কেজির ‘প্রাণ মিনিকেট’ চালও বিক্রি হচ্ছে ৪৪০ টাকা দামে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাণের সিনিয়র ম্যানেজার নিয়াজ মোরশেদ বলেন, ‘কোয়ালিটি ভালো হওয়ায় দামও বেশি। এই বাড়তি দাম থেকে পরিবেশকদের ৩ শতাংশ ও খুচরা বিক্রেতাদের ১১ শতাংশ কমিশন দেওয়া হয়। তবে সুপারশপ এই চাল বিক্রি করলে কমিশনের পুরোটাই তারা পায়। এ ছাড়া ৫ কেজির প্যাকেটে খরচও হয় ২৫ টাকা। তাই বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। আমাদেরও ২৫ বা ৫০ কেজির বস্তা চাল ১৭০০ টাকা থেকে ৩৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজির দাম ৬৮ টাকা।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কৃষকের কাছ থেকে মিনিকেট নামেই ধান কিনি। তাই মিনিকেট ব্রান্ড নামেই বিক্রি করা হচ্ছে। সরকার বন্ধ করে দিলে আমাদের আপত্তি নেই।’

উল্লেখ্য, প্যাকেটজাতের নামে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চাল, ডাল, লবণসহ প্রায় সব নিত্যপণ্য বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করছে। এমন অভিযোগ পাওয়ায় জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে। সেখানে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত নেই। সুতরাং এই নামে চাল বিক্রি করা হচ্ছে ভোক্তার সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা।

এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, ‘মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত নেই। মোটাচাল কেটে চিকন করে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। বেশি দামে মিনিকেট ব্রান্ড করে বিক্রি করা হচ্ছে। তাই কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মিলমালিকসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আসলে বিষয়টা হলো এ মুহূর্তে অভিযান করে মিনিকেট বন্ধ করে দিলে একই চাল নতুন নামে বাজারে আসবে। এটা কোনো সমাধান নয়। তাই সরকারিভাবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে প্যাকেটজাত পণ্যের মূল্য বেশি। এটা কমাতে হবে। কারণ অন্য চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে।’

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে বলেছেন, ‘মিনিকেট বলে কিছু নেই। একসময় ভারত থেকে চিকন চালের বীজ আনা হতো মিনি সাইজের প্যাকেটে করে। এই হলো মিনিপ্যাক। এই বীজকে আমরা নাম দিয়েছি মিনিকেট চাল। ভোক্তা অধিকার এই মিনিকেট নাম উচ্ছেদ করতে অভিযান চালাতে পারে। আমাদের সে সক্ষমতা নেই।’

উল্লেখ্য, এবার বোরো ধানের ভরা মৌসুমেও চালের দাম কমেনি। বরং ক্রমান্বয়ে দাম বাড়তে থাকে। সরকার চাল আমদানির উপর ট্যাক্স কমানোর পরও বাজারে এর প্রভাব পড়ছে না। বাধ্য হয়ে সরকার কঠোর অবস্থানে যায়। ভোক্তা অধিদপ্তর বিভিন্ন বাজার ও সুপারশপে অভিযান পরিচালনা করে একটা তালিকা করে। তাতে প্যাকেটজাত চালের বেশি দাম ধরা পড়ে। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেকে এই বাড়তি দাম যৌক্তিক কি না তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

সূত্র : ঢাকাপ্রকাশ