মাথা গোঁজার ঠাই পেল বিশ্বনাথের ৯ প্রতিবন্ধী পরিবার

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের দেয়া ভূমিসহ বাড়ি পেলেন বিশ্বনাথ উপজেলার ৯টি প্রতিবন্ধী পরিবার। উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের পাঠাকইন গ্রামে ২০ শতক জায়গা ক্রয় করে প্রায় ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯টি বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

যাদের সবার জন্য আলাদা মিটারে বিদ্যুৎ সংযোগ ও একটি গভীর নলকূপও দেয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার (৭মার্চ) বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ভূমিহীন প্রতিবন্ধী পরিবারের জন্য দেয়া উপহারের ঘরগুলো পরিদর্শন করেন বিভাগীয় কমিশনার ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ও সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান।

এসময় তারা প্রত্যেকটি পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে তাদের বিস্তারিত খোঁজখবর নেন। পাশাপাশি প্রত্যেক পরিবারের মাঝে নগদ ২ হাজার টাকা, তিনটি করে ফলজ গাছের চারা, সবজীর বীজ ও শীতের কম্বল বিতরণ করেন। পরে খালি জায়গায় আম ও লেবুর চারা রোপন করেন তাঁরা।

এসময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুসরাত জাহান, উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) আসমা জাহান সরকার, পল্লিবিদ্যুৎ বিশ্বনাথ জোনাল অফিসের ডিজিএম সাইফুল ইসলাম।

পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিভাগীয় কমিশনার ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে; কেউ গৃহহীন, ভূমিহীন থাকবে না। এ লক্ষেই আমরা কাজ শুরু করি। সিলেট ডিভিশনে ৪১ টি উপজেলায় প্রায় ২১ হাজার ভূমিহীন আমরা চিহ্নিত করেছি। ইতিমধ্যে প্রায় ১৫ হাজার ৫০০ পরিবারকে আমরা ভূমিসহ ঘর হস্তান্তর করেছি। এই মাসের ২১ তারিখের মধ্যে আরও ৩ হাজার ঘর আমরা হস্তান্তর করবো। এই কার্যক্রমকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করেছি। একটি হল যাদের জমিও নেই ঘরও নেই। তাদের জন্য খাস জমিতে ঘর তৈরি করে দেয়া হচ্ছে।’

তিনি বলেন, বিশ্বনাথের আমতৈল গ্রামের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নজরেও আছে এটি একটি প্রতিবন্ধী এলাকা। এখানে বেশিরভাগ পরিবার প্রতিবন্ধী। তাই তাদের নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এছাড়া তাদের জীবন মান উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা কাজ করছি। আমরা কিছু প্রতিবন্ধী পরিবার পেয়েছি যাদের ভূমিও নেই, ঘরও নেই। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে সেটা জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাদের জন্য পাশাপাশি এলাকায় জমি কিনে ঘর তৈরি করে দাও। সেই নির্দেশ মোতাবেক আজ তাদের জমি কিনে একটি খোলামেলা জায়গায় ঘর তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এটি একটি অনন্য উপহার। আর যাদের জমি আছে তাদের ঘর ভাল নেই। আমতৈলে সেইসব প্রতিবন্ধী ৭১টি পরিবারকে ঘর তৈরি করে দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে।’

তিনি বলেন, ঘর পাওয়া ৯টি পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে আমরা কথা বললাম। তারা নিজের নামে জমিসহ ঘর পেয়ে অনেক খুশি। তারা সবাই প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করছেন।

জানা যায়, বিশ্বনাথ উপজেলা সদর হতে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরবর্তী রামপাশা ইউনিয়নের জমশেরপুর, ধলীপাড়া, মাখরগাঁও ও আমতৈল নামক চারটি গ্রাম একত্রে বৃহত্তর আমতৈল গ্রাম নামে পরিচিত। আমতৈল গ্রামের মোট আয়তন ৪.৮৫ বর্গ কি:মি: এবং মোট লোকসংখ্যা ১৬,১০৫ জন। এদের জীবনমান দেশের অন্য যে কোন এলাকার তুলনায় অত্যন্ত নিম্নমানের।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী গত বছরের মে মাসে উপকারভোগী প্রতিবন্ধীদের গৃহ পরিদর্শন করে, প্রতিবন্ধীদের জমির পরিমাণ এবং গৃহের ধরণ সম্বলিত তালিকা প্রস্তুত করে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুসারে মোট ৪৩১ জন উপকারভোগীর তথ্য পাওয়া যায়। কিছু সংখ্যক উপকারভোগী স্থানান্তরিত হয়েছে অন্যত্র।

অবিশ্বাস্যভাবে আমতৈল গ্রামে মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২০৮ জন। তন্মধ্যে “ক” শ্রেণির ০৯ জন ভূমিহীন ও গৃহহীন এবং “খ” শ্রেণির ০২ জন গৃহহীন রয়েছে। অবশিষ্ট সকলেরই জমি ও গৃহ রয়েছে। তবে অধিকাংশের জমির পরিমাণ ১ শতক থেকে ৫ শতকের মধ্যে এবং অধিকাংশের কাঁচা ও টিনের ঘর রয়েছে। এর মধ্যে ”ক” শ্রেণির ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য নির্মাণকৃত ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানান, বন্যাকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় খাদ্য সহায়তা ও আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। মুজিববর্ষ উপলক্ষে তৃতীয় পর্যায়ে ভূমিহীন ও গৃহহীন ৩৩ পরিবারের জন্য নির্মিত ঘরগুলো এবারের ঈদ উপহার হিসেবে হস্তান্তর করা হয়। এরমধ্যে খাজাঞ্চি ইউনিয়নের পৌষণী মৌজায় ১৮টি, দেওকলস ইউনিয়নের দেওকলস মৌজায় ৭টি ও অলংকারি ইউনিয়নে দক্ষিণ সিরাজপুর মৌজায় ৮টি ঘর। এরআগে ১ম পর্যায়ে উপজেলায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মধ্যে ২৬৫টি পরিবারকে ঘর দেয়া হয়।

এদিকে সিভিল সার্জনের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের মে মাসে উপজেলার আমতৈল গ্রামে বিশেষ মেডিকেল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ৯২ জন প্রতিবন্ধী শিশুকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। এর মধ্যে ৪৯ ছেলে এবং ৪৩ জন মেয়ে রোগী। অধিকাংশ শিশুই সেরিব্রাল পালসি (৩৭ জন) এবং রিকেটস (১২ জন) রোগী ছিলো।

সমাজসেবা সূত্রে জানা যায়, আমতৈল গ্রামে প্রতিবন্ধী জরিপ অনুযায়ি প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা ২৫৩ জন। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন ২৩৩ জন, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন ১০ জন। তন্মধ্যে ২০৮ জন এলাকায় অবস্থান করেন। বাকিরা অন্যত্র বসবাস করেন।

আমতৈল গ্রামের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. এস. এম. শাহরিয়ার বলেন, আমতৈল গ্রামটি খুবই ঘনবসতিপূর্ণ। বর্তমানে এখানে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় তিন শত। তন্মধ্যে অধিকাংশ মানুষই নিম্নআয়ের মৎস্যজীবি। ফলে তারা প্রয়োজনীয় পুষ্টি সেবা থেকে বঞ্চিত। সামাজিক এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার কম। এ গ্রামের শিশু জন্ম হার বেশী। প্রতিটি পরিবারের সন্তান সংখ্যা গড়ে ৫-৮ জন। দারিদ্রের কারণে এদের শিক্ষার হারও তুলনামূলকভাবে কম। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিশ্বনাথ একই ইউনিয়নের সাবেক ৩ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মী এবং ঔষধপত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ থাকলেও শিক্ষার অভাব, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে আমতৈল গ্রামের অধিকাংশ গর্ভবতী মায়েরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে প্রসূতি এবং চিকিৎসা সেবা গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন। ফলে তারা গর্ভকালীন অত্যাবশ্যকীয় ৪ টি এন্টিনেটাল চেকআপসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন। তাদের অধিকাংশই বাড়ীতে বাচ্চা প্রসব করেন।

তিনি বলেন, প্রসবকালীন জটিলতার কারণে সেরিব্রাল পালসি রোগটি বেশী বলে অনুমিত। পাশাপাশি দারিদ্রের কারণে মা ও শিশু প্রয়োজনীয় পুষ্টিসেবা থেকেও বঞ্চিত হন। ফলে এখানে রিকেটস রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা যুগোপযোগী ও স্বাস্থ্য সম্মত নয়। আমতৈল গ্রামে প্রতিবন্ধির সংখ্যা বেশী হওয়াতে সামাজিক কুসংস্কারের কারণে বিবাহ উপযুক্ত ছেলে-মেয়েদের অন্যত্র বিয়ে হয় না। তারা একই গ্রামের ভিতরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফলে বংশানুক্রমিক ধারায় কিছু কিছু জন্মগত রোগের হার এ গ্রামে বেশি।

বিদ্যমান সমস্যা সমাধানকল্পে করণীয় বিষয় নিয়ে তিনি জানান, ইতোপূর্বে প্রস্তাবিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করা এবং জনবল নিয়োগ করা প্রয়োজন।

এর মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বিশ্বনাথে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ স্কীম চালু করন, মোবাইল মেডিকেল ও পরিবার পরিকল্পনা টিমের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, প্রতিবন্ধীতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্মসূচি গ্রহন, গর্ভবতী মায়েদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে শতভাগে উন্নীত করণের জন্য গৃহীত কর্মসূচি জোরদারকরণ, এনজিওদের অধিক সম্পৃক্তকরণ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ব্যানার/বিলবোর্ড স্থাপনেরও প্রয়োজন বলে জানান তিনি।

এছাড়া সামাজিক এবং ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের পাশাপাশি স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও ধর্মীয় নেতাদের অন্তর্ভুক্তিকরণ, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন ব্যবস্থার মান উন্নয়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে বিশেষ পাঠ দানের ব্যবস্থা করণের প্রয়োজন হিসেবে উল্লেখ করেন সিভিল সার্জন ডা. এস. এম. শাহরিয়ার।