পর্যটন সমৃদ্ধ কমলগঞ্জ উপজেলায় মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। দেশী বিদেশী পর্যটকরা সাধারণত পর্যটন এলাকার ভালো হোটেল বা রিসোর্টে অবস্থান করেন। তবে একেবারে আবাসিক পরিবেশে পরিবারের মাঝে অবস্থান করে পর্যটকরা পর্যটন এলাকা ঘুরতে পারেন। এমন ধারণার শুরু হয় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের আদমপুর ইউনিয়নের আদিবাসী মনিপুরীদের ভানুবিল মাঝের গাঁও গ্রামে।
এ গ্রামের নিরঞ্জন সিনহা রাজুর বাড়িতে ২০১৮ সালের ৩ জুন সিলেটর তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন মণিপুরি কমিউনিটি বেইজ ট্যুরিজম। শুরুতে ১০ মণিপুরি পরিবার সদস্যদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন এ গ্রামের ৭৫টি বাড়িতে গড়ে উঠেছে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম। দেশী বিদেশী পর্যটকরা এতে একেবারে পারিবারিকভাবে অবস্থান করে একে অন্যের খাবার, সামাজিকতা, সংস্কৃতি আচার-আচরণ, সামাজিক পরিবেশ ইত্যাদি বিনময় করার সুযোগ পাচ্ছেন। করোনা কালীন দুর্যোগ সময়ে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম অনেকটা থমকে গেলেও আবারও পর্যটকদের পছেন্দের তালিকায় রয়েছে মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম।
যেভাবে শুরু :
নিরঞ্জন সিনহার ভগ্নিপতি রবিন ঢাকায় সিলেইক নামে মণিপুরি তাঁতবস্ত্রের একটি কারখানা ও শো-রুম করে। আর এ তাঁতবস্ত্র রপ্তানি শুরু করে জাপানে। এ ব্যবসার সূত্র ধরে জাপানি ক্রেতারা কমলগঞ্জের আদমপুরের ভানুবিল মাঝের গাঁও এসে একেবারে গ্রামীন পরিবেশে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র তৈরী ও এখানকার সামাজিক অবস্থান দেখে মুগ্ধ হয়। তাদের এ আসা যাওয়ার সূত্র ধরে নিরঞ্জন সিনহা নিজ বাড়িতে বিদেশী (জাপানি) পর্যটকদের রেখে তাদের আদর যত্ন করে এখানকার পর্যটন এলাকা ঘুরিয়ে দেখাতেন। বিদেশী পর্যটকরা মণিপুরি বাড়িতে বসবাস করে মণিপুরি খাবার দাবার, সামাজিকতা, আচার আচরণ, সংস্কৃতি, আতীথেয়তা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়। আর মণিপুরি পরিবারগুলোও বিদেশী পর্যটকদের খাবার দাবার, সামাজিকতা, সংস্কৃতি, আচার আচরণ ও পরিবেশ সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়।
আরজিএস ট্যুর এর মালিক শামীম আহমেদ তাদের প্রয়োজনে ভানুবিল গ্রামে এসে মণিপুরী পরিবারে পর্যটকদের রেখে পর্যটন উন্নয়ন দেখে মুগ্ধ হয়ে বিষয়টি তৎকালীন সিলেট বিভাগীয় কমিশনারকে অবহিত করলে বিভাগীয় কমিশনার ২০১৮ সালের ৩ জুন এখানে এসে মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমের উদ্বোধন করেন। সাথে সাথে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সাথে এটিকে যুক্ত করে প্রথমে ১০টি মণিপুরি পরিবার নিয়ে পর্যটন উন্নয়নে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন। এখন ভানুবিল গ্রামে ৭৫টি পরিবারে গড়ে উঠেছে মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম। ট্যুরিজম বোর্ডের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন ট্যুর গাইডদের সাথেও মণিপুরি কমিউনিটি বেইজ ট্যুরিজম যুক্ত হয়েছে। পর্যটকরা এখানে গ্রাম্য পরিবেশে দূষণমুক্তভাবে বেড়ানোর ও খাবার দাবারের সুযোগ পায়। এখানে পর্যটকদের প্রয়োজেন স্বলাকারে মণিপুরি সংস্কৃতি তুলে ধরে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজনও করা হয়।
একই সাথে প্রতিটি কমিউনিটি বেইজ ট্যুরিজম পরিবারে রয়েছে মণিপুরী তাঁত বস্ত্র, তাঁতবস্ত্র তৈরীর প্রদর্শণী তাঁত, মণিপুরি মিনি যাদুঘর। অবসরে ঘরে বসে পড়ার মত সু-ব্যবস্থা।
পর্যটকদের ব্যয় :
মনিপুরি বাড়িতে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমে ৪ জনের পারিবারিক পরিচ্ছন্ন কক্ষে মাত্র ২ হাজার টাকায় থাকতে পারছেন। ৩ বেলা খাবারে আগে ৭০০ টাকা ব্যয় হলেও এখন দ্রব্য মূল্যের উর্দ্ধগতিতে এখন খাচ্ছেন ৯০০ টাকায়। এ ট্যুরিজমে একেবারে ভিন্ন পরিবেশে পর্যটকদের মুড়ির মোয়ার সাথে হারবাল চা পরিবেশন করা হয়। খাবারে নিজেদের উৎপাদিত বিষমুক্ত শাক সবজি ব্যবহার করা হয়। ৪ জনের কক্ষে যদি একজন পর্যটক থাকেন তা হলে তাকে দিতে হয় মাত্র ১ হাজার টাকা।
নিরাপত্তা :
কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমে প্রশাসনিক সহায়তার সাথে পর্যটন পুলিশেরও নজরদারি থাকে। এখানে অহেতুক প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। মণিপুরি পরিবারের নারীরা বাড়িতে পর্যটকদের সেবাযত্ন ও রান্নার কাজ করেন। আর পুরুষ সদস্যরা হাট বাজার করার সাথে পর্যটকের পছন্দের মাধবপুর লেক, বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতি সৌধ, স্মৃতি যাদুঘর, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হামহাম জলপ্রপাত এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরতে ব্যবস্থা করা ছাড়াও সাথে থাকেন। অনতি দূরে ত্রিপুরা সীমান্ত এলাকা থাকায় এসব গ্রামের সবুজ পরিবেশও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
কৃষি প্রধান এলাকা ভানুবিল গ্রামে গেলে মণিপুরি কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমের নিরঞ্জন সিনহা বলেন, এ ব্যবস্থাপনায় পর্যটকরা এ পরিবেশে থাকতে বেশী পছন্দ করে। করোনার থাবা কাটিয়ে উঠে এখন বিদেশী পর্যটকরা এখানে আসতে চাচ্ছে। পারিবারিকভাবে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার সুয়োগে রয়েছে। এখানে নেশা গ্রহনের কোন সুযোগ নেই। পর্যটক ও মণিপুরি পরিবার সদস্যরা সবাই নিজ নিজ একটি অবস্থান থেকে অবস্থান করায় উভয় পক্ষের থাকে সামাজিকও পারিবারিক নিরাপত্তা। তিনি বলেন, আগামী ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ভারতের মনিপুর থেকে ১৭০ জনের একটি পর্যটক দল আসার জন্য বুকিং করেছে। তিনি মনে করেন আগামী এক বছরে এখানে ১০০০ পর্যটক আসবে ভারত থেকে। এর মাঝে বেশী আসবে ভারতের মণিপুর থেকে। যোগাযোগ ০১৭১১৩৮৯৮১৭।
যাতায়াত :
দেশের যে কোন স্থান থেকে ট্রেনে কমলগঞ্জের ভানুগাছ রেলওয়ে অথবা শমশেরনগর রেলওয়ে স্টেশনে অবতরণ করে প্রাইভেট কারে, সিএনজিতে সরাসরি আদমপুরের ভানুবিল গ্রামে যাওয়া যায়। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরত্বের ভানুবিল গ্রামে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো।সড়ক পথেও সহজে ভানুবিল গ্রামে যাাতায়াত করা যায়।