ভয়াবহ বন্যা ও মানসিক প্রস্তুতি

সিলেট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সিলেটের জনজীবন, অজস্র স্বপ্ন, হাঁড়ভাঙা খাটুনিতে গড়ে তোলা সম্পদ সবকিছু গেছে পানির নিচে। কৃষকের গরু, শিক্ষার্থীর বই, কম্পিউটার, মাছ চাষির বিনিয়োগ কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর জীবিকার উপকরণ- কোনো কিছুই পায়নি রেহাই।

পানিতে ডুবে স্বজনের মৃত্যু, হারিয়ে যাওয়া লাশ উদ্ধারের দৃশ্য কিংবা হৃদয়বিদারক অনিশ্চিত পানিবন্দি মানুষের পাংশু মুখের ছবি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। দেশের এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ পরিবার ও স্বজনের সাথে যোগাযোগ করতে নানা আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে। কারো কারো ক্ষেত্রে নিজের বসতভিটা পানির তলে ডুবে যাওয়ার খবর আসছে। পোষা প্রাণী, স্মৃতিবহ স্থাপনা কিংবা দীর্ঘ বছরের মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ আমরা একই সাথে লক্ষ্য করছি, ওই অঞ্চলে নৌকা, মোমবাতি, খাবার পানিসহ সব পণ্যের দাম স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বাড়ানোর অমানবিক চিত্র। এখন পর্যন্ত একজন তরুণের লাশ উদ্ধার, গরু ডুবে যাওয়া, একটি শিশুর ডুবে যাওয়ার ভিডিও ফেসবুকে স্ক্রল করে দেখতে পেয়েছি। এই ভিডিওগুলো মনটাকে কেমন অস্থির করে তুলেছে। নিজেকে ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কিছু করা উচিৎ এই বিপন্ন মানুষগুলোর জন্য। কোনো কাজে মনোযোগ বসছে না। কিন্তু আমার একার পক্ষে হয়তো কি বা করা সম্ভব? হয়তো কিছুই না।

বলতে গেলে নিজের অশান্ত মনকে সান্ত্বনা দেয়ার প্রয়াসে এই লেখাটি লিখছি। যদি ১ জন মানুষের নিজেকে স্থির করতে এই লেখাটি একটুও কাজে লাগে, মানসিক শান্তি পাব। বন্যার এই বিপদগ্রস্ত সময়ে আমরা কি করতে পারি? কিভাবে মানসিক স্থিরতা এবং ধৈর্য ধারণ করতে পারি? কোন কাজগুলো পরিহার করা প্রয়োজন? কিভাবে মনোবল ধরে রাখা যায়? কাজটা মোটেই সহজ নয়। ধরুন, একজনের মাথায় কেউ একটা শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করলো। তার মাথা ফেটে ক্রমাগত রক্ত ঝরছে। আর একজন তাকে বলছে কিভাবে কম ব্যথা অনুভব যায়। এটা কি তার ব্যথা কি এতে কমবে?

কমতে পারে, যদি আগে সঠিকভাবে ড্রেসিং করা যায়, যদি ক্ষত ব্যান্ডেজ করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। সেই কাজটাই সবার আগে করতে হবে। বন্যার্ত প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে হবে। অনেক প্রতিবন্ধকতার পরেও আমাদের মানবিক বোধ মরে যায়নি বলেই আজো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সংগঠন ও ব্যক্তি এগিয়ে আসছেন এই দুর্যোগের সময়টায়। এই অর্থায়ন ও ত্রাণ সঠিকভাবে উপযুক্ত ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করার উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া সহজ হবে।

যারা স্বজন হারিয়েছেন কিংবা ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশু, ফসল, সঞ্চয় ডুবে গেছে – তাদের সমব্যথা অন্য কারো অনুধাবন হওয়া সম্ভব না। দীর্ঘদিন এমনকি আজীবন এই ক্ষতি তাদের মনে ক্ষত তৈরি করবে। প্রথমত, যে বিষয়টা একটু দ্রুত স্বাভাবিক হতে এবং এই পরিস্থিতিতে নিজেকে স্থির রাখতে সহায়ক হতে পরে, সেটা হলো গ্রহণ করা বা মেনে নেয়া।

মানুষ খুব ক্ষুদ্র, অসহায় প্রকৃতির সামনে। আমার সীমাবদ্ধতা এবং তুচ্ছতার জায়গা হচ্ছে আমি পারি না প্রকৃতির রোষানল ফেরাতে, আমি পারি না বন্যা থামিয়ে দিতে, আমি পারি না হারানো স্বজনকে ফিরিয়ে আনতে, তছনছ হয়ে যাওয়া সাজানো সংসার ফিরিয়ে আনতে কিংবা সব কিছু আগের মতো করে তুলতে মুহূর্তেই। চাইলেই আমরা অনেক কিছু পারব না এবং অনেক কিছু এই জগতে প্রতিনিয়ত ঘটবে যা আমাদের স্বার্থ, ভালো থাকা পরিপন্থী। হয়তো আমরা তা প্রত্যাশা করি না। আমাদের পরিশ্রম, যোগ্যতা কিংবা প্রাপ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নয়। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় মানুষ হিসেবে আমরা পারি না, পারার নয়। এই সীমাবদ্ধতা মানতে না পারলে পরিস্থিতি সামলে ওঠা খুব কঠিন।

এই যে বন্যা, এই যে ক্ষয়ক্ষতি- কেন আমার সাথেই এমন হলো? আমি কি পাপ করেছি? কেন আমার জীবনটাই তছনছ হয়ে গেল? কেন আমার ঘরই ডুবলো। আমি কেন ভিক্টিম হলাম- এরকম ভাবনাগুলো মনে আসতে পারে অসহায়ত্বের সময়টায়। আসলে কেন এমনটা হলো এই ভাবনার চেয়ে এখন অধিক তাৎপর্যপূর্ণ হলো, কিভাবে এখান থেকে উত্তরণ ঘটানো যায়। সেজন্য প্রয়োজন ধৈর্য ধারণ। আমার কি চলে গেছে, তার চেয়ে কি আছে, কোথা থেকে শুরু করা যায় এই ভাবনাটা সহায়ক। কিন্তু এই ইতিবাচক ভাবনা মানুষের সহজাত নয়। বিশেষ করে যখন ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ও ভয়াবহতা অনেক তীব্র। তবুও নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যা আছে তাই নিয়ে নতুন শুরুর স্বপ্ন দেখতে হবে, যদি কিছুই না থাকে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। আমরা যে আবার উঠে দাঁড়াতে পারি এই বিশ্বাসটা রাখা জরুরি। সেই সাথে ভিজ্যুয়ালাইজ করা অর্থাৎ ইতিবাচক দৃশ্যকল্প থাকাটা জরুরি।

মানবজাতির ইতিহাসে বন্যা, মহামারী, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি অজস্র প্রাণ কেড়েছে, অসংখ্য সম্পদের বিনাশ ঘটিয়েছে। মানুষ বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে। যত দিন আমাদের ১৬ কোটি মানুষের মাঝে মানবিক দৃষ্টিকোণ থাকবে, আমরা হয়তো কষ্টে থাকবো, হয়তো প্রত্যাশিত জীবনমান অর্জিত হবে না, কিন্তু আমরা কেউ না খেয়ে মারা যাব না। আমার যদি বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা থাকে, আমি যদি পরিশ্রমী হই, দুর্যোগ মোকাবিলায় আন্তরিক সহায়তা পাই, অবশ্যই আবার মানসম্মত প্রত্যাশিত জীবনের সম্ভাবনা রয়েছে।

বন্যায় সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পরে শিশু-কিশোর ও শিক্ষার্থীরা। আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবেশ এবং জীবনমান তাদের জন্য খুব সহায়ক নয়। স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডুবে যাওয়ায় পড়াশোনায় দীর্ঘবিরতি এবং প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। যে সময়টায় সবচেয়ে বেশি পুষ্টি দরকার, সে সময়টায় অভাবের মধ্যে পরে যাওয়া তাদের জীবনভর ভোগাতে পারে। দুর্যোগের সময়টায় বা পরবর্তীতে খেয়ে পরে বাঁচাই হয় চ্যালেঞ্জিং, পুষ্টির বিষয়টা সেখানে বিলাসিতা মনে হতে পারে। কিন্তু এই সময়টায় এনজিও, বিভিন্ন সংগঠন ও ত্রাণ পরিকল্পনাকারীদের মা ও শিশুর পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে হবে। চাল, ডালের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পুষ্টিকর শিশু খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা জরুরি। নদীমাতৃক দেশ হিসেবে আমাদের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোর কারিকুলামে সাঁতার শেখাটা যুক্ত করা জরুরি। কারিকুলামে না থাকলেও সাঁতার শেখা সময়ের দাবি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কাজগুলো সহায়ক হতে পারে- ১. ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত দুচিন্তা কাজ করলে নিজেকে কোনো কাজে যুক্ত করা। হতে পারে, স্বেচ্ছাসেবকের কাজ কিংবা পরিবারের সদস্যদের দেখভাল করা। এতে মন শান্ত থাকে। বন্যার সময়টায় নিজের, পরিবারের এবং আশপাশের মানুষগুলোর সার্বিক তত্ত্বাবধানে সক্রিয় থাকলে মনোবল বাড়তে পারে। কাজের সাথে যুক্ত থাকলে ব্যস্ততার কারণে দুশ্চিন্তা ও কষ্টগুলো কম প্রভাব ফেলতে পারে। ২. হাল না ছাড়া, মনোবল ধরে রাখা। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা, অন্তত ভবিষ্যতকে মোকাবিলার জন্য নিজেকে টিকিয়ে রাখা দরকার। ৩. খাবার গ্রহণ, ঘুমসহ দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো ঠিক রাখার চেষ্টা করা। ৪. যার যার জায়গা থেকে মানবিক, পরোপকারী আচরণ করা। এই দুঃসময়ে মানুষকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা কামাই মানুষ হিসেবে আমাদের ইমেজকে নিজের কাছে ক্ষুণ্ন করে। মানসিক প্রশান্তির জন্য তা ক্ষতিকর। ৫. যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন, এই দুর্যোগকে তারা স্রষ্টার একটি পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করেন। স্রষ্টার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা ও সমর্পণ তাদের মানসিক অস্থিরতা লাঘবে সহায়তা করে। কোনো কিছুর কার্যকরণ বিশ্লেষণ ব্যতীত একটি সর্বশক্তিমান সত্তার হাতে এর ভার সমর্পণ করে মানবমন নির্ভার বোধ করতে পারে। যারা প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদকে অনুসরণ করেন, এই দুর্যোগকে তারা সারভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্টের জন্য প্রকৃতির ‘ফিটেস্ট নির্বাচনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। ৬. ভয়াবহ বন্যার মানসিক স্বাস্থ্য ইস্যুগুলোর মধ্যে ডিপ্রেশন, এ্যাংজাইটি, ট্রমা, মৃত্যুভীতি, প্যানিক এ্যাটাক, শোক অন্যতম। স্বজন, সহায় সম্বল হারানো পানিবন্দি, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রতিটি মানুষ ও তাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্বজনদের প্রয়োজনীতা অনুসারে কাউন্সেলিং প্রযোজ্য। কারণ তাদের জীবনে এমন কিছু রাত, এমন কিছু মুহূর্ত গেছে যা সারা জীবনে দাগ কাটার মতো। এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করা প্রয়োজনএ সীতাকুণ্ড অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও আহত ও নিহতদের স্বজন, ফায়ার ফাইটার, ওই এলাকায়। স্থানীয় মানুষদের ট্রমা ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করি। সেই ঝুঁকি নিরূপণে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা দরকার। ৭. আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্যা সংক্রান্ত কোনো ছবি বা ভিডিও শেয়ার করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। আমার ছড়ানো কন্টেন্ট যেন কারো ট্রমা, বিষণ্নতা, নিদ্রাহীনতা, খেতে অরুচির কারণ না হয়। বিশেষ করে সারা দেশের শিশু-কিশোররা এই কন্টেন্টগুলো দেখে তীব্র আতঙ্কিত হতে পারে। নিজের স্বজাতির মৃত্যু দেখলে মৃত্যুভীতি তৈরি হতে পারে। কেউ ভাবতে পারেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে সুবোধ সাজা হচ্ছে। কিন্তু এই সত্যটা অস্বীকার করা যায় না যে, সবার মানসিক দৃঢ়তা সমান নয়। ৮. অনুভূতি একজন থেকে আরেক জনে ছড়াতে পারে। পরিবারের শিশুদের সামনে এই দুর্যোগের সময় বিভিন্ন নেতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা তাদের প্রভাবিত করতে পারে। এমনিতেই তারা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই সময়টায় যতটা সম্ভব নিরাপদ অনুভব করতে সাহায্য করতে হবে। ৯. মানসিক যন্ত্রণা ও কষ্টের অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করা। প্রয়োজনে মনোবিদের শরণাপন্ন হওয়া।

মানবিক প্রয়াসে লাঘব হোক মানসিক যন্ত্রণা। এই দুর্যোগ পরিণত হোক জাতিগত ঐক্যের মহামিলনে। শোক থেকে শক্তি নিয়ে মানবতার প্রত্যয়ে জেগে উঠুক বাংলাদেশ।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়