জুনের মারাত্মক বন্যা বাংলাদেশ ও আসাম-মেঘালয়ের বিস্তীর্ণ অংশ প্লাবিত করে রেখেছিল অনেক দিন। দুই দেশ মিলিয়ে মারা গেছে দেড় শতাধিক মানুষ। অবশেষে এ বন্যার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারতের আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা।
ইন্ডিয়া মেটিরিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (আইএমডি) সূত্রে জানানো হয়েছে, এ বছরের জুনে ‘ইস্টারলি উইন্ড’ তথা পূবালী হাওয়ার অভাবেই মনসুন দীর্ঘ সময় ধরে ওই অঞ্চলের আকাশে থমকে ছিল এবং সে কারণেই ওখানে নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
বন্যার কারণ হিসেবে সাধারণত অতিবৃষ্টিকে দায়ী করা হলেও কেন অত অল্প সময়ে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছিল, তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা এতদিন ছিল না।
আসামের নদীগুলো যে ফুঁসছে এবং ভাটির এলাকাকে ভাসিয়ে দিতে যাচ্ছে, সেই তথ্য সময়মতো বাংলাদেশকে জানানো হয়েছিল কি না, উঠেছিল সে প্রশ্নও।
এবার আইএমডি-র জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী আর কে জেনামনি বলছেন, ‘জুনে পূব দিক থেকে একটা জোরালো হাওয়া থাকে বলেই বাদল মেঘ ক্রমশ উত্তর ও মধ্য ভারতের দিকে সরে আসে। কিন্তু এবার আশ্চর্যজনকভাবে হাওয়াটা একেবারেই ছিল না। যার কারণে মেঘ উত্তর-পূর্ব ভারতের আকাশে একটানা থমকে ছিল বহুদিন। তাতেই আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে রেকর্ডভাঙা বৃষ্টি হয়েছে ওই কদিন ধরে।’
বস্তুত এ বছরের ১১ থেকে ১৯ জুনের ভেতর ওই অঞ্চলে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, গত একশ বছরেও এমন বৃষ্টির নজির নেই। মাত্র আট দিনে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মোট ৩৩৪৫ মিমি বৃষ্টিপাত হয়। মনসুনের পুরো চার মাসেও মুম্বাই অঞ্চলে এতটা বৃষ্টি হয় না।
ফলে ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদী রাতারাতি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইতে শুরু করে। বন্যাকবলিত হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। ২৯ জুন মণিপুরে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে পাহাড় ধসে একসঙ্গে ৪২ জন নিহতও হন।
তবে পূবালী হাওয়ার অভাবই এই মারাত্মক অতিবৃষ্টির একমাত্র কারণ ছিল না। আইএমডি-র বিজ্ঞানীরা আরও জানাচ্ছেন, ‘একে তো ইস্টারলি উইন্ড ছিল না– তার ওপর বঙ্গোপসাগর থেকে দক্ষিণা বায়ু আর আরব সাগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম বায়ু এবার নিয়ে এসেছিল বাড়তি আর্দ্রতা। যাতে আসাম-বাংলাদেশে বৃষ্টির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।
বছরের এই সময়টায় উড়িষ্যার ওপর সাধারণত একটা ‘উইন্ড সিস্টেম ফরমেশন’ হয়। যেটা উত্তর-পূর্ব ভারত অভিমুখী বায়ুর প্রভাবকে বেশ খানিকটা প্রশমিত করে। দুর্ভাগ্যবশত সেটাও এবছর হয়নি। এতেও সংকট আরও গভীর হয়।
পূবালী হাওয়া মনসুনকে ক্রমশ গাঙ্গেয় অববাহিকার দিকে ঠেলে দেয় বলেই জুনের মাঝামাঝি থেকে বিহার-উত্তরপ্রদেশ-মধ্যপ্রদেশে বৃষ্টি হতে শুরু করে। কিন্তু এবারে যেহেতু সেটা হয়নি, পুরো জুন মাসটা জুড়েই গোটা উত্তর ও মধ্য ভারতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে।
উড়িষ্যাতেও স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৭ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। ফলে ভারতে গমের ফলনও এবার সাঙ্ঘাতিক মার খেয়েছে। পূবালী হাওয়ার এই অস্বাভাবিক অনুপস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জই যে প্রধানত দায়ী, বিশেষজ্ঞরা সে বিষয়েও একরকম নিশ্চিত।
দিল্লি আইআইটির প্রকৌশলী ও হাইড্রোলজি বিশেষজ্ঞ অশোক কুমার কেশরী ‘থার্ড পোল’ ওয়েবসাইটকে বলেন, ‘ক্লাইমেট চেঞ্জের জন্য যখনই একটা ভৌগোলিক অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তখন সেখানকার উইন্ড সার্কুলেশন প্যাটার্নও পাল্টে যায়। এখানেও সেরকম ব্যাপার ঘটেছে বলে আমি নিশ্চিত।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, সাধারণত আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর থেকে যে বাতাস আসে তা বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ‘পিক’ করে। কিন্তু এবার ঘটনাচক্রে দুটোই ‘পিক’ করেছে একই সময়ে, অর্থাৎ জুনের মাঝামাঝি। তাতেই পরিস্থিতি আরও সঙ্কটাপন্ন হয়েছে।
বাংলাদেশের নজিরবিহীন বন্যা মোকাবিলায় ভারত যে সব রকমভাবে সাহায্য করতে প্রস্তুত, গত মাসে দিল্লিতে জেসিসি বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে সে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ভারতের বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, আপাতত বন্যার পানি কমে আসার পর দুই দেশেরই উচিত হবে ক্লাইমেট চেঞ্জের প্রভাব রুখতে একসঙ্গে কাজ করা।