‘ভাটির সিংহপুরুষ’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জন্মদিন আজ। তিনি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির এক কিংবদন্তি।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৫ সালের ৫ মে দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা চিকিৎসক দেবেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মা সুমতি বালা সেনগুপ্ত। তিনি দিরাই উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স গ্র্যাজুয়েট ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রিও অর্জন করেন।
তিনি ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) পিকিং ও মস্কো ধারায় দুই ভাগ হলে মাওলানা ভাসানীর পক্ষ ত্যাগ করে সুরঞ্জিত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশে যোগ দেন।
প্রয়াত রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা ২৯ মিনিটে রাজধানী ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে জাতি হারাল একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ; বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ হারাল একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, আর আমরা হারালাম সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রসেনানীকে।’
ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি থেকে উঠে আসা বামপন্থি এই নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। দীর্ঘ ৫৯ বছর রাজনীতি করেছেন দাপটের সঙ্গে। বক্তৃতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করার চমৎকার ক্ষমতা ছিলো সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মধ্যে। যে কোন জটিল বা কঠিন বিষয় হাস্যরসের মাধ্যমে বলার অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ৫ নং সেক্টরের অধীন টেকেরঘাট সাব সেক্টরে প্রথম সাবসেক্টর কমান্ডার এবং পরে সংগঠক, ১৯৭২ সালে সাংবিধানিক সংসদ সদস্য, দিরাই-শাল্লা থেকে পরপর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৭০-এর নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ন্যাপ থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ন্যাপের ভাঙনের পর গণতন্ত্রী পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মোট সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৮৬ ও ১৯৯১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়ী হন। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সুরঞ্জিত প্রথমে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে সভাপতিম-লীর সদস্য হন। পঞ্চম সংসদের সদস্য থাকাকালেই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরে দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য হন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে সুরঞ্জিত সেন ভোটে হেরে গেলেও পরে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ-বানিয়াচঙ আসনে উপ-নির্বাচন করে তিনি বিজয়ী হন। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন তিনি।
২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর সুরঞ্জিতকে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে ২০১১ সালের ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী করা হয় তাঁকে। ব্যক্তিগত সহকারীর দুর্নীতির দায় মাথায় নিয়ে ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় রেখে দেন। পরে তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সুরঞ্জিতকে নির্দোষ ঘোষণা করে।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি পুনরায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তাঁর মৃত্যুর পর দিরাই-শাল্লা আসনের উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন তাঁর স্ত্রী ড. জয়া সেন গুপ্তা। বিগত সংসদ নির্বাচনেও এই আসনে জয়া সেন নির্বাচিত হন।