বয়স বাড়িয়ে বিয়ে, ‘সংকটে’ মিলছে না কাবিননামা

১৪ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে রহিমাকে। বিয়ের নিবন্ধনে বয়স তখন ঠিকই ১৮ লেখা হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের সময় পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি কাবিননামার কপি। বলা হয়েছিল— মেয়ের বয়স ১৮ হওয়ার পরেই মিলবে কাবিননামার কপি। রহিমার বয়স এখন ২০। অর্ধযুগের সংসারে ছেদ পড়েছে। সম্প্রতি এক সন্তানের জননী রহিমার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে। আর জন্য আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার পর খোঁজ পড়েছে কাবিননামার। কিন্তু সেই কাগজের হদিস পায়নি কেউ। রহিমাও বঞ্চিত হয়েছেন তার সন্তানের অধিকার থেকে।

রহিমার মতো হাজারও গৃহবধূ এমন বিপদের মুখোমুখি। অভিভাবকরা আসছেন রাজশাহী মহিলা আইনজীবী সমিতির অফিসে। তাদের সবারই কণ্ঠে একই সুর, বিয়ের কোনও ডকুমেন্ট নেই। আইনজীবীরা বলছেন, বাল্যবিয়ে কৌশলে নিবন্ধন করা হয়। বিয়েতে কোনও ঝামেলা না হলে ‘কপাল ভালো’। তবে পরবর্তী সময়ে ‘কোনও ঝামেলা’ হলে দাবি করতে পারছেন না আইনি সহযোগিতা। এমনকি এমন ঘটনায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততা থাকতে হয় বলে মামলাও হয় হাতে গোনা।

রাজশাহীর গোদাগাড়ির প্রত্যন্ত অঞ্চলের সায়েমার (ছদ্মনাম) বাবা রফিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। স্কুল বন্ধ করে ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া সায়েমার বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কারণ সেই পুরনো, বড় হয়ে গেলে বিয়ে দিতে ভোগান্তি! মাত্র তিন বছরের মাথায় বাবার বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হন সায়েমা। সঙ্গে ছয় মাসের একটি সন্তান। কী করবেন বুঝতে না পেরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির পরামর্শে ভরণপোষণের দাবি জানান। কিন্তু সেই বিয়েই অস্বীকার করে বসে সায়েমার বর।

রফিকুল ইসলামের ভাষ্য, ‘আমাদের কাছে মেয়ের বিয়ের বিষয়ে সমাজ ছাড়া আর কোনও প্রমাণ নেই। শহরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলাম লুকিয়ে। এখন এই সন্তান নিয়ে মেয়েটা আমার চলবে কী করে? কাজী তখন বলেছিলেন, বিয়ে নিবন্ধন হয়েছে, মেয়ের ১৮ বছর হলে কাগজ পাওয়া যাবে। সেই কাজী মারাও গেছেন, এখন মেয়ের বিয়েরতো আর কোনও প্রমাণই নাকি নেই।’

২০১৪ সালের গার্লস সামিটের পর থেকেই, বাংলাদেশে বিবাহের ন্যূনতম বয়স কমিয়ে আনার বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরপর সংসদে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭’ পাস হয়। এ আইন পাসের কারণে ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট-১৯২৯’ বাতিল হয়ে যায়।

কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে প্রশ্নে এধরনের মামলা পরিচালনায় অভিজ্ঞ রাজশাহীর আইনজীবী দিলসিতারা চুনি বলেন, ‘আমরা এরকম বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। কাবিননামা বা নিকাহনামা বিয়ের একমাত্র লিখিত প্রামাণ্য দলিল। সুতরাং, বিয়েসংক্রান্ত যেকোনও সমস্যায় এর প্রয়োজন হয়। বিয়েবিষয়ক প্রতারণার সবচেয়ে বেশি শিকার হন নারীরা। রেজিস্ট্রেশন না করায় অনেক ক্ষেত্রে বিয়েটি অস্বীকার করা হয়। সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। স্ত্রী ও সন্তানকে ভরণপোষণ দেওয়া বন্ধ করে দিলে, স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে আরেকটি বিয়ে করলে বা স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেনমোহর থেকে বঞ্চিত করলে, বা প্রতারণা করে বিবাহিত থাকা অবস্থায় আর কাউকে বিয়ে করলে স্ত্রীর জন্য বিয়েটি আদালতে প্রমাণ করা অত্যন্ত কষ্টসাপেক্ষ। এসব ক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতে কোনও নালিশ করতে চাইলে প্রথমেই বিয়ের প্রমাণ হিসেবে রেজিস্ট্রিকৃত নিকাহনামা আদালতে জমা দিতে হয়।’

নিবন্ধন নিয়ে জটিলতা রয়ে গেছে উল্লেখ করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর অর্পিতা দাস বলেন, ‘বাল্যবিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের নিবন্ধনের বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। কাজীদের নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে কাজ করা উচিত। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক সচেতনতামূলক কর্মসূচি হচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, নিবন্ধন ইস্যুতে কাজীদের নিয়ে আরও নিবিড়ভাবে কাজের সুযোগ আছে।’

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনানুযায়ী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি কোনও ব্যক্তির লিখিত বা মৌখিক আবেদন অথবা অন্য কোনও মাধ্যমে বাল্যবিবাহের সংবাদ পেলে তিনি ওই বিবাহ বন্ধ করবেন, অথবা বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। স্থানীয় আইনজীবীরা বলছেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করায় বাল্যবিয়ের মামলা প্রায় হয় না বললেই চলে। বাল্যবিয়ে প্রদানকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করা গেলে দ্রুত এই পরিস্থিতি পরিবর্তন করা যেতো।

বাল্যবিবাহ আইনটি ছিল ১৯২৯ সালের আইন। যা পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের সংশোধন হয় উল্লেখ করে বাল্যবিবাহ আইন বিষয়ে আইনজীবী মলয় সাহা বলেন, ‘এই আইনের সুনির্দিষ্ট করে ৪ ধারায় বলা হয়েছে, যদি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অথবা সরকারের জনপদের প্রতিনিধির নজরে বাল্যবিবাহ আসে, তাহলে তারা মামলা করে প্রতিরোধ করতে পারেন।’

তিনি বলেন, ‘বাল্যবিবাহ আইনের বিচার সম্পর্কে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে বলা আছে, অপরাধের দুই বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। থানায়, আদালতে অথবা ভ্রাম্যমাণ আদালতে এ মামলা করা যাবে। এই মামলাটির বিচার হবে সামারি ট্রায়াল (সংক্ষিপ্ত বিচার)। বিচার করবেন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদার যেকোনও ম্যাজিস্ট্রেট অথবা ভ্রাম্যমাণ আদালত।’

আইনজীবী মলয় সাহা বলেন, ‘বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করতে হলে অবশ্যই স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ সামাজিকভাবে আরও সচেতন করতে হবে।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন