বেড়েছে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স, কাটছে ডলার সংকট

বিগত বছরের যে কোনও সময়ের চেয়ে দেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে। এ ছাড়া বেড়ে চলেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সও। বিলাসী পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে ডলার সংকট। এ ছাড়া আইএমএফের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই অর্থ।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে আশাবাদ দেখছে আইএমএফ। আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বলছে, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হবে ৭ হাজার ৫৮ কোটি মার্কিন ডলার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৬৯০ কোটি ডলার। গত ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক সম্পর্কে যে প্রাক্কলন করেছে, তাতে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশি পণ্যের অন্যতম রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয় বর্তমানে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধায় পণ্য রপ্তানি করা যায়। ২০২৯ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা বহাল থাকবে। এটাকেও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসাবে) ২০ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার বেশি। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স আসছে ৬ কোটি ৩১ লাখ ডলারের বেশি। আগের মাস ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬৯ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহের একই ধারা বইছে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেও। এই মাসের প্রথম ১০ দিনে ৬৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা দৈনিক গড়ে ৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বা প্রায় ৬৮৮ কোটি টাকার বেশি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ফেব্রুয়ারিতে ২৮ দিনে রেমিট্যান্স ১৮০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়তে শুরু করেছে। সামনে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা রয়েছে। এ দুই উৎসব ঘিরে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়বে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, ‘গত এক মাসে রেমিট্যান্সের ভালো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এসেছে ১০ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, আর জানুয়ারি মাসের হিসাব যোগ দিলে দাঁড়াবে ১২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। তিনি উল্লেখ করে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি দিন দিন চাঙা হচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। আমাদের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) টানা ২ বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছিল। এর পরের মাস সেপ্টেম্বর থেকে টানা পাঁচ মাস দেড় বিলিয়ন ডলারের ঘরেই থেমে যায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স আসে ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার, আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। অর্থবছরের শুরুর দুই মাস ২ বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স আসে।

এরপর সেপ্টেম্বর থেকে কমতে থাকে রেমিট্যান্স প্রবাহ, যা মাসিক হিসাবে দেড় বিলিয়ন বা তার কাছাকাছি চলে আসে। গত সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার, অক্টোবরে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার, নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার, ডিসেম্বরে প্রায় ১৭০ কোটি ডলার বা ১৬৯ কোটি ৯৬ লাখ মার্কিন ডলার। আর সদ্য বিদায়ী জানুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার।

২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ (২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এটি তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ (২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা।

সংঘবদ্ধ হুন্ডি চক্রের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৬ হাজার এজেন্ট চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। একই সঙ্গে ৫ হাজার ৫৫৭ সুবিধাভোগীকে চিহ্নিত করে তাদের এমএফএস হিসাব ফ্রিজ করা হয়। অবৈধভাবে আর টাকা আনবেন না, এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে এর মধ্যে ৩ হাজারের মতো হিসাব সচল করা হয়েছে। তাদের অনেকেই এখন বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, হুন্ডি প্রবণতা ঠেকাতে বিএফআইইউর বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে রেমিট্যান্স বেড়ে প্রায় ১৯৬ কোটি ডলার এসেছে। আগামী মাসগুলোতে আরও বাড়বে।

জানা গেছে, বিএফআইইউ এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন ৫ হাজার ৭৬৬ জন এজেন্ট চিহ্নিত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে হুন্ডিতে জড়িত ২ হাজার ২৬৬ জন এজেন্ট এবং তিনজন ডিস্ট্রিবিউটরের এজেন্টশিপ বাতিল করা হয়েছে। আর বিএফআইইউ যে ৫ হাজার ৫৫৭ সুবিধাভোগীর এমএফএস হিসাব অবরুদ্ধ করেছিল, সেখানে জমার পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৩২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। এদের মধ্যে ২ হাজার ৯৫৩টি হিসাব সচল করা হয়েছে। বাকি ২ হাজার ৬১৪টি হিসাবে শুধু উত্তোলন বন্ধ আছে। এর মধ্যে ৮০০ জনের বেশি হিসাবধারী তাদের হিসাব সচল করার লিখিত আবেদন করেছেন।

এদিকে বিশ্বমন্দার মধ্যে তৈরি পোশাকের হাত ধরে জানুয়ারি মাসে রফতানি আয় বেড়েছে ২৮ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন (ইউএস) ডলার, যা শতকরা হিসাবে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পণ্য রফতানি হয়েছে ৫১৩ কোটি ৬২ লাখ ৪০ হাজার ইউএস ডলার। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে যা হয়েছিল ৪৮৫ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার। শতাংশের হিসাবে ২০২২ সালের জানুয়ারির তুলনায় ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে রফতানি আয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, বৈশ্বিক মন্দার মাঝেও বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে সুবাতাস বইছে। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে তৈরি পোশাক খাত।

তিনি বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই সময়ের মধ্যে আমাদের সামগ্রিক পোশাক রপ্তানি ২৩ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়ে ২৭ দশমিক ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। নিটওয়্যার পণ্য রপ্তানি ১৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যখন ওভেন পণ্য রফতানি হয়েছে ১২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উভয় ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। তাই ওভেন খাতে প্রবৃদ্ধি নিটওয়্যারের তুলনায় বেশি হয়েছে।