বুদ্ধি প্রতিবন্ধি বাবা-ভাইয়ের পাশে কী দাঁড়াতে পারবেন রুবেল

গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত শিক্ষার্থী রুবেল আহমদ। ছবি: সিলেট ভয়েস

মিরপুর বাংলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রুবেল আহমদ। ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিন সকালে পুলিশের ছোঁড়া সাউন্ড গ্রেনেড এসে লাগে তার হাতে। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় বাম হাতের কব্জি। ছাত্র-জনতার মিছিলের মাঝখানে থাকা রুবেল তাৎক্ষণিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তার বন্ধুরা উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান।

কিন্তু উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ঢাকার কোনো হাসপাতালে ভর্তি রুবেলের জন্য নিরাপদ ছিল না। পরে সিলেটে রুবেলের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর বন্ধুরা। পরিবারের পরামর্শে ঢাকা থেকে এনে সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করা হয় রুবেলকে। বর্তমানে হাসপাতালের ৩১ নং ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন রুবেল। রুবেলের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায়। পড়াশুনার জন্য ঢাকায় বসবাস করেন তিনি। পড়াশুনা ছাড়াও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন রুবেল।

বুধবার (১৪ আগস্ট) সিলেট এমএজি ওসমানী হাসপাতালে আহত রুবেলের সাথে কথা হয় সিলেট ভয়েসের। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ নিয়ে রুবেল বলেন, ‘দুই বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় আমি। আমার বাবা ও একমাত্র ভাই বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। সেদিন (৫ আগস্ট) সকালে মিছিলে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু একটি যৌক্তিক আন্দোলনে নেমে এরকম হামলার শিকার হবো তা কল্পনাও করতে পারছি না।’

পঙ্গুত্ব বরণের আশঙ্কায় থাকা রুবেল বলেন, বাবা ও ভাই বুদ্ধি প্রতিবন্দ্বি হওয়ায় পরিবারের একমাত্র ভরসা আমি। দুই বোনসহ সবাইকে আমার দেখাশোনা করতে হেয়। কিন্তু গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে হাতের কব্জি ক্ষত-বিক্ষত হওয়ায় স্বাভাবিক হয়ে বাঁচতে পারবো কী না জানি না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুবেল বলেন, আবার কী আগের মতো সুস্থ হতে পারবো। আবার কী সংসারের হাল ধরতে পারবো? আবার কী আমার পড়ার টেবিলে বসতে পারবো?

রুবেলের মতো আরও অনেকেই কোটা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। কেউ কেউ এখনও ফেলছেন চোখের পানি। কেউ আবার বীভৎস স্মৃতিগুলোর কথা মনে করে তাকিয়ে আছেন অপলক দৃষ্টিতে। কেউবা আবার পঙ্গুত্ব বরণ করে ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কী না সে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায়।

ওসমানী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহত হয়ে এখন পর্যন্ত ২৩৪ জন ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে দু’য়েকজন ছাড়া সবাই গুলিবিদ্ধ। আহতদের মধ্যে শুধুমাত্র ১৯ বছরের এক কিশোর দগ্ধ অবস্থায় ভর্তি হয়েছেন। বাকি প্রত্যেকের শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলির চিহ্ন রয়েছে।

আন্দোলনের সময় ৫ আগস্ট ঢাকা যাত্রাবাড়ি এলাকায় বন্ধুদের সাথে মিছিলে গিয়েছিলেন মো. মিজান মিয়া (২৩)। পুলিশের গুলিতে তার বাম পা আঘাত প্রাপ্ত হয়।। সুনামগঞ্জের হালুয়ারঘাটের বাসিন্দা মিজানের সাথে রয়েছেন তার মা মজিদা বেগম।

তিনি বলেন, হাসপাতাল বিনামূল্যে চিকিৎসা হওয়ায় প্রাণে বেঁচে আছি। আর অনেক মানুষ দেখতে এসে টাকা পয়সা দিয়ে গেছেন। দশদিন থেকে আমার ছেলে বিছানায় পড়ে আছে। চিকিৎসা তো হচ্ছে, অনেক সময় লাগবে ভাল হতে। আমি চাই, আমার ছেলের মত যারা পুলিশের গুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের বিচার হোক।

হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের পুকড়া ইউনিয়নের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফয়ছল তালুকদার (১৯)। ২ আগস্ট হবিগঞ্জ সদরে মিছিলে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হোন। ওই রাতেই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে ভর্তি হোন তিনি। এরই মাঝে তার পায়ে চারবার অস্ত্রোপচার হয়েছে।

ফয়সলের বাবা মো. আব্দুল আহাদ বলেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি করার পর ২ আগস্ট আমার ছেলেরে একটি অস্ত্রোপচার হয়েছে। পরে আরও গুলি ভেতরে থেকে যাওয়ায় পরপর তিনবার অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তখন অস্ত্রোপচারে খরচাপাতি লেগেছে। এখন আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যয় বহন করছে। কিন্তু টাকা বিষয় না, আমার ছেলের যে ক্ষতি হয়েছে তার বিচার চাই সরকারের কাছে।

সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার ২ নং সাদিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রায়হান আহমদ (১৭) ছাত্র বন্ধুবান্ধব মিলে ঢাকা যাত্রাবাড়ীতে যান ২০ জুলাই। তখনো কোটা আন্দোলন ততটা দেশব্যাপী সাড়া ফেলেনি। তবে যাত্রাবাড়ীতে ৫ আগস্ট সংগঠিত হওয়া মিছিলে পুলিশের সরাসরি গুলিতে রায়হান আহমদ গুরুতরভাবে আহত হয়। তার ডান হাতের কনুইয়ের একপাশ থেকে গুলি বের হয়ে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়।

ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সৌমিত্র চক্রবর্ত্তী বলেন, সিলেটে সাম্প্রতিক সহিংসতায় মোট ১০ জন নিহতের মধ্যে ১ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তাদের মধ্যে মাত্র দুইজনের ময়নাতদন্ত হয়েছে। তারা হলেন শাবি শিক্ষার্থী রুদ্র সেন এবং সিলেটের স্থানীয় দৈনিক উত্তরপূর্ব পত্রিকার সাংবাদিক শহীদ এ টি এম তুরাব। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেসি সহযোগিতা না পাওয়ায় বাকি ৮ জনের ময়নাতদন্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।

আহতদের চিকিৎসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা প্রথম থেকেই রোগীদের চিকিৎসার্থে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সকল চিকিৎসকরা রোগীদের সেবাদানে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে ভর্তি হওয়া প্রতিটি রোগীর জন্য অধ্যাপক দ্বারা মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিনামূল্যে যাবতীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে রোগীদের সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পরিচালকসহ সবাইকে অবহিত করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আইসিইউতে থাকা তিনজনের মধ্যে ১জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। বাকি ২জনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। আমরা সবকিছু ফ্রিতে দিচ্ছি, তবে যে সকল মেডিসিন হাসপাতালে পাওয়া যায় না সেগুলোও বাইরে থেকে এনে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।