দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে মুক্তিকামী বাঙালি। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ের দিনকয়েক আগেই ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হত্যাযজ্ঞ ঘটায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের তালিকায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে একযোগে বহু বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।
বাংলাপিডিয়ার হিসাব বলছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এক হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকায়। ১৪৯ জন। এসব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার ঘটনায় বিচার হলেও দণ্ড কার্যকর হয়নি নয় বছরেও।
এরমধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড হলেও তাদের ফাঁসি কার্যকর করা যায়নি। ২০১৩ সালে এই রায় হওয়ার পর দীর্ঘ ৯ বছর কেটে গেছে।
এতদিনেও দণ্ড কার্যকর না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা। তারা বলেছেন, চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি। পাশাপাশি আসামিদের ফেরাতে যে সেল গড়ে তোলা হয়েছে তা কার্যকর করতে হবে।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর রানাদাস গুপ্ত বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলেন মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। তারা পলাতক থাকা অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণা হয়। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় তাদের। কিন্তু তারা পলাতক থাকায় রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
আসামিদের কেন ফেরানো যাচ্ছে না- এ বিষয়ে তিনি বলেন, এটার পেছনে কারণ থাকতে পারে। আসামিরা যে সব দেশে রয়েছে ওইসব দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। তাই তাদের বাংলাদেশে পাঠাতে আগ্রহ নেই দেশগুলোর। অথবা তারা এখানে আসামিদের পাঠাতে বিলম্ব করছে। তাদের দেশে আনা হলেই তো দণ্ড কার্যকর করা হবে। এখন তারা সেখানে আছে রাজনৈতিক আশ্রয়ে। এখন এজন্য দরকার সরকারের উদ্যোগ।
প্রসিকিউটর বলেন, তাদের ফেরত আনতে হলে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি করতে হবে। এই চুক্তি যদি করা না হয় তাহলে প্রত্যর্পণটা বাস্তবায়ন হবে কেমনে। এজন্য সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বার বার বলে আসছেন, মঈনুদ্দীন ও আশরাফকে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, আর মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন।
তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান ও সমন্বয় এম সানাউল হক বলেন, আপাতত অগ্রগতি নেই। তবে সরকার চেষ্টা করছে। আশা করি এক সময় আনতে সক্ষম হবে।
সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ নেবে- এমন প্রশ্নের জবাবে এম সানাউল হক বলেন, বিদেশে পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে ওয়ারেন্ট তো দেওয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা তার অধীনস্থ পুলিশ সদরদপ্তর থেকে। তবে এটা কো অর্ডিয়েন্স করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমি মনে করি শুধু এই দুই আসামি না, আরও যে সব আসামি পলাতক রয়েছে তাদের ফিরিয়ে আনতে একটি শক্তিশালী সেল করার উদ্যোগে নেওয়া দরকার।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দুদিন আগে বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। এতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত মরদেহ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের মরদেহ শনাক্তও করা যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক, ছয় সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডে মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ওঠা ১১টি অভিযোগই প্রমাণিত হয়। ফলে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর তাদের মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসায় তার ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে এই হত্যার পরিকল্পনা ও টার্গেট ব্যক্তিদের তালিকা পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, এএনএম গোলাম মুস্তাফা, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লা কায়সার, চিকিৎসক মো. ফজলে রাব্বী ও আলিম চৌধুরীকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। তবে ওই হত্যার মূল খলনায়ক ছিলেন মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনার নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। তাদের মৃত্যুদণ্ড না হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।
মঈনুদ্দীনের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞা থানার চানপুর গ্রামে। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসাইন। একাত্তরে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা আলবদর বাহিনীতে তাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দায়িত্ব দেওয়া হয়। যুদ্ধের শেষভাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মঈনুদ্দীন পালিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে। এখন পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। একাত্তরে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে থাকার কথা নিজের ওয়েবসাইটে দেওয়া বিবৃতিতে স্বীকারও করেছেন তিনি।
আরেক খুনি আশরাফুজ্জামান খানের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চিলেরপাড় গ্রামে। বাবার নাম আজহার আলী খান। ১৯৬৭ সালে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর আশরাফুজ্জামান ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি স্টাডিজ বিভাগে। ওই বিভাগ থেকেই ১৯৭০ সালে স্নাতক ডিগ্রি পান ইসলামি ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা আশরাফুজ্জামান।