হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ দুটি বাজারের মধ্যে একটি বাজার হলো গ্যানিংগঞ্জ বাজার। এ বাজারে গণশৌচাগার সংকটে দুর্বিষহ কষ্ট ভোগ করে যাচ্ছেন ক্রেতা-বিক্রেতা ও জনসাধারণ।
প্রায় ৩৫-৪০ বছর পূর্বে বাজার কর্তৃপক্ষ মসজিদের মুসল্লী ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের প্রাকৃতিক কাজ সারার সুবিধার্থে গ্যানিংগঞ্জ বাজার জামে মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিমে ৩টি অস্বাস্থ্যকর খোলা গণশৌচাগার নির্মাণ করেছিল। তখনকার সময়ে বাজারে মুসল্লী, ক্রেতা-বিক্রেতা ও জনসাধারণ বর্তমান জনসংখ্যার চেয়ে পাঁচ গুণ কম ছিল। ওই স্থানে এখন ৭টি গণশৌচাগার থাকলেও অনেক সময় ময়লা ও পানি নিষ্কাশনের সমস্যায় কোনো কোনোটি অচল হয়ে পড়ে যা অস্বাস্থ্যকর।
মসজিদ ও বাজার কর্তৃপক্ষের আবেদনে হবিগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খানের অনুদানে মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণে বছরখানেক পূর্বে মল-মূত্র ত্যাগের ব্যবস্থা করায় বিশেষ ব্যক্তিরা উপকৃত হলেও তা গণশৌচাগার হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয়। কারণ দুটি শৌচাগারই তালাবদ্ধ থাকে।
বাজারের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমের ব্যবসায়ীসহ অন্যরা প্রাকৃতিক কাজের চাপে পড়লে প্রস্তুতি নিয়ে যেতে না যেতেই অনেক বয়স্ক, বহুমূত্র রোগীদের কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। আর যারা শৌচাগার পর্যন্ত পৌঁছান, তখন দেখা যায় সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষমান একাধিক ব্যক্তি। ফলে পড়তে হয় বিপাকে।
গ্যানিংগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আজ অবধি বাজার কর্তৃপক্ষ ক্রেতা-বিক্রেতা ও জনসাধারণের জন্য কোনো গণশৌচাগার নির্মাণ করেনি। প্রায় ৩৫-৪০ বছর যাবত বাজারবাসীর জন্য আগেরগুলোই গণশৌচাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর এই গণশৌচাগারে বাজারবাসী প্রাকৃতিক কাজ সারতে এসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। প্রস্রাব-পায়খানার চাপ সামলাতে না পেরে নিরুপায় হয়ে অনেকেই দোকানপাট ও বাসা-বাড়ির আড়ালে, খালে-বিলে, বিভিন্ন নালা-নর্দমায় ও খোলা স্থানে আশ্রয় নিচ্ছেন। এ সময় অনেকেই নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়ে থাকেন।
এতে দুর্গন্ধজনিত কারণে পরিবেশেরও মারাত্মক দূষণ ঘটছে। প্রাকৃতিক কাজের ব্যাঘাত ঘটলে জনসাধারণের শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় মারাত্মক ক্ষতিসাধনও হতে পারে।
বানিয়াচং উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচও) ড. শামিমা আক্তারের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হলে তিনি জানান, দীর্ঘ সময় প্রস্রাব-পায়খানা আটকে রাখার ফলে নষ্ট হতে পারে মূত্রথলি, কিডনি ও শরীরের অন্যান্য প্রত্যঙ্গ। প্রস্রাবের চাপ আটকে রাখা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মল-মূত্র আটকে রাখলে এটা মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় এবং এর ফলে মূত্রাশয়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। সংক্রমিত হয় মূত্রথলি, কিডনি ও অন্যান্য প্রত্যঙ্গ।
জানা যায়, গ্যানিংগঞ্জ বাজারে ছোট-বড় প্রায় ৮০০ দোকান রয়েছে। এসব দোকানের ব্যবসায়ী ও কর্মচারী মিলে প্রায় ২ হাজার লোক নিয়মিত বারো-চৌদ্দ ঘণ্টা যাবত এ বাজারে অবস্থান করেন। উপজেলা সদরের ব্যস্ততম এই বাজারে প্রতিদিনই উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন থেকে বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রায় ১৫-২০ হাজার লোকের সমাগম হয়। এছাড়া পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকেও মানুষ এসে থাকেন। বিশাল এ বাজারে হাতেগোনা কয়েকটি মালিকানাধীন মার্কেটে শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকলেও তা শুধু ব্যবসায়ীরাই ব্যবহারের সুযোগ পান।
বর্তমানে এই বাজারে আগত জনসাধারণ, ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মল-মূত্র ত্যাগের একমাত্র ভরসাস্থল বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে নির্মিত ৭টি গণশৌচাগার। যদিও নামে ১০টি গণশৌচাগার আছে। তন্মধ্যে ৩টি শৌচাগার ময়লা-আবর্জনা ফেলায় অকেজো হয়ে পড়েছে।
শৌচাগারের প্রতিটি দরজার সামনে ময়লা-আবর্জনার স্তুপে খুবই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বাজারে ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্থান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট করে না দেওয়ায় যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে।
এছাড়া বাজারে অনেকেরই মালিকানাধীন বড় বড় মার্কেট রয়েছে। বাজারের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে কিশোর সংঘ, শাহজালাল মার্কেট ও জাহাঙ্গীর মার্কেটে বিভিন্ন মালিকানায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫০ জন ব্যবসায়ী ও কর্মচারী রয়েছেন। মার্কেটগুলো থেকে বছরে লাখ লাখ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। অথচ প্রায় ১৫ বছর যাবত এসব মার্কেটের ভাড়াটে ব্যবসায়ী ও ক্রেতা সাধারণের জন্য মল-মূত্র ত্যাগ করার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। তারা বিকল্প শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করছেন নানা জায়গায় ময়লা-আবর্জনা ফেলার স্তুপ ও দোকানঘরের আশপাশের নির্জন জায়গা। আবার কেউ বা বাজারের আশপাশে বিভিন্ন স্বজন ও পরিচিতজনের বাসা-বাড়িতে হাজির হতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে নারীদের জন্যও নেই কোনো আলাদা গণশৌচাগার। যার ফলে তাদের কষ্টের কোনো সীমা থাকে না।
এ বাজারের ক্রেতা, বিক্রেতা ও জনসাধারণ জানান, গণশৌচাগারের অভাবে প্রতিদিনই তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়। বিশেষ করে যারা বহুমুত্র রোগ, পেটের পীড়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত, তাদের মারাত্মক বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়। দীর্ঘ সময় প্রস্রাব-পায়খানা আটকে রাখার ফলে কিডনি জটিলতাসহ নানা রোগে ভুগছেন অনেকে। বাজারের ক্রেতা, বিক্রেতা ও জনসাধারণের দুর্বিষহ কষ্ট লাঘবে উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব (ফায়ার সার্ভিস থেকে কাঠপট্টি) ও দক্ষিণ-পশ্চিমে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাজার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গণশৌচাগার নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
গ্যানিংগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে মুঠোফোনে না পেয়ে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. মতিউর রহমান মতির সাথে কথা হলে তিনি জানান, জনসংখ্যার তুলনায় এ বাজারে গণশৌচাগারের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। অচিরেই সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়ে গণশৌচাগারের অপ্রতুলতা ও ময়লা-আবর্জনায় সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও জানান, ব্যবসায়ীদের সার্বিক সমস্যা সমাধানে বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে মুষলধারে বৃষ্টির দিনে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সুবিধার্থে মধ্য বাজারের পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত টিন শেডের ছাউনি নির্মাণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।