চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৯ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যা ১ লাখ ২০ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০২ টাকা করে)। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৭৪ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ১ হাজার ১৭৯ কোটি (১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ও আশানুরূপ রেমিট্যান্স প্রবাহ না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বর শেষে সেবা খাতে দেশ আয় করে ৩৬৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে সেবা খাতে দেশের ব্যয় ৫৩৯ কোটি ডলার। এতে সেবা খাতের ঘাটতি ১৭৩ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৩৬ কোটি ডলার।
ব্যাংকারদের মতে, চলতি হিসাব বা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। অর্থাৎ নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স এখন ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে নভেম্বর শেষে এ ঘাটতির অঙ্ক ৫৬৭ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ৬২২ কোটি ডলার। সামগ্রিক লেনদেনেও (ওভার অল ব্যালেন্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। নভেম্বর শেষে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) অঙ্ক ৬৩৮ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ২০২ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল।
দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর ১৮৫ কোটি ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ১৯৭ কোটি ডলারে উঠেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে, সেটিকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও বেড়ে ৯০ কোটি ৫০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৮৭ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করে। অর্থবছরজুড়ে সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন হয়েছিল। প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। কিন্তু রেমিট্যান্স কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল।
এবার আমদানি ব্যয়ে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আমদানির চেয়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। তবে সেই প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়ে অনেক কম, ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৫ শতাংশ।
গত অর্থবছরে এই পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স ২১ শতাংশ নেগেটিভ (ঋণাত্মক) প্রবৃদ্ধি হলেও এবার ২ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে লেনদেন ভারসাম্যে ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান মনসুর বলেন, ‘আমদানিতে এখনো যে গতি রয়েছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে; রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে যদি ভালো প্রবৃদ্ধি না হয়, তাহলে এবারও ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে।’
২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর। তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।