বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে হচ্ছে ‘সেপা’ চুক্তি

সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সিইপিএ বা সেপা) নামে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারত। তবে এটা ঠিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরকালেই এটি সই হতে পারে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, চুক্তিটি স্বাক্ষরের জন্য আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করার সবুজ সংকেত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই চুক্তি হলে উভয় দেশের রপ্তানি আয় বাড়বে বলে দুই দেশের বিশেষজ্ঞরাই মত দিচ্ছেন।

সিইপিএ (সেপা) চুক্তির ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও নিটল নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, এটা হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পণ্য আদান-প্রদানের চুক্তি। ভারতের সঙ্গে এই চুক্তি হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। কারণ ভারত থেকে বেশি পণ্য আমদানি হয়। আমাদের কম পণ্য রপ্তানি হয়। এতে তারা বেশি ট্যাক্স পাচ্ছে। আমরা এলডিসি গ্রাজুয়েশন অর্জন করছি। এটা পুরোপুরি কার্যকর হলে ভারত ট্যাক্স চাইবে। তাই আগে থেকে এই চুক্তি হলে তারা আর বাড়তি ট্যাক্স নিতে পারবে না। জাপান, মালয়েশিয়া ইতোমধ্যে ভারতের সঙ্গে এই চুক্তি করেছে। তাই ব্যবসা বৃদ্ধির স্বার্থেই এই চুক্তি দরকার। তাতে আমাদের ভ্যাট, ট্যাক্স লাগবে না।

জানা যায়, এটি হবে যেকোনো দেশের সঙ্গে ঢাকার প্রথম বাণিজ্য চুক্তি। চীন ও জাপানের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার অনুরোধ সত্ত্বেও ভারতকে অগ্রাধিকার দিয়েছে বাংলাদেশ। জাপান ও চীনের সঙ্গে চুক্তিগুলো এখনও মূল্যায়ন পর্যায়ে রয়েছে।

প্রস্তাবিত চুক্তির ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ১৯০ শতাংশ এবং ভারতের ১৮৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং মোট দেশজ উৎপাদন যথাক্রমে ১ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ০৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এই হিসাব ঢাকা-দিল্লি যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় প্রকাশ করা হয়েছে।

সেপা চুক্তিতে পণ্য ও পরিষেবা, বিনিয়োগ, মেধা সম্পত্তি অধিকার এবং ই-কমার্স অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এখন কথা হলো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সঙ্গে সেপার পার্থক্য তাহলে কী? এর উত্তর হলো- সেপাকে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট হিসেবেও ধরা যায়। তবে সেপার ব্যাপ্তি সাধারণ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে অনেক বেশি। পণ্যের মুক্ত বাণিজ্যের পাশাপাশি শুল্ক সহযোগিতা এবং মেধাস্বত্ব অধিকারের মতো বিষয়গুলোও সেপার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত অর্থবছরে প্রথমবারের মতো ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ভারত থেকে আমদানি মোট ১৪ বিলিয়ন ডলার।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য এলাকা চুক্তির অধীনে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ভারতে তামাক ও অ্যালকোহলসহ ২৫টি পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করছে।

২০২১ সালের মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় দুই প্রধানমন্ত্রী সেপা চুক্তি স্বাক্ষর সম্পর্কিত যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ করার নির্দেশনা দেন। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট ও ভারতের সেন্টার ফর রিজিওনাল ট্রেড বিশদ যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে।

চলতি বছরের মে মাসে উভয় প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা প্রতিবেদন নিজ নিজ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। প্রতিবেদনে সেপা স্বাক্ষরের জন্য আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার চূড়ান্ত খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একবার বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হলে পরবর্তী ৭ থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার এবং ভারতের ৪ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পাবে। এটি উভয় দেশের জন্য নতুন বিনিয়োগের দরজা খুলবে।

যৌথ সমীক্ষায় এটাও বলা হয়েছে, ‘এটি উপসংহারে পৌঁছানো যেতে পারে এই সমীক্ষার অনুমান এবং বিশ্লেষণ ইঙ্গিত করে যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রস্তাবিত সেপা শুধু সম্ভাব্যই নয় বরং পণ্য ও পরিষেবার বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য লাভের ক্ষেত্রে পারস্পরিক উপকারীও।’

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। একারণেই দুই দেশের মধ্যে এ ধরনের একটি চুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে দুই পক্ষই।

ভারত যে শুধু বাংলাদেশের সঙ্গেই সেপা চুক্তি করতে যাচ্ছে তা নয়। দেশটি এর আগে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ১৯৯৮ সালেই সেপা চুক্তি করেছে। এরপর সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ২০০৫ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ২০০৯ সালে, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ২০১০-১১ সালে এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে করেছে ২০১৫ সালে সেপা চুক্তি করে। তবে বাংলাদেশ এখনো কারও সঙ্গে সেপা চুক্তি করেনি। ভারতের সঙ্গেই প্রথম এই চুক্তি হতে যাচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়শীল দেশের কাতারে যাবে, তখন আর সাফটার বিদ্যমান সুবিধা পাওয়া যাবে না। সেই চিন্তা থেকেই ভারতের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তির প্রস্তাব বাংলাদেশই করে।