বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত টিনা দাসকে বিয়ে করেছেন ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের নারী সুবিক্ষা সুব্রাহ্মণী। গেল বুধবার চেন্নাইয়ে তামিল রীতিনীতি মেনে ধুমধামের সাথে বিয়ে করেন তারা। সুবিক্ষা এবং তার স্ত্রী টিনা, দুজনেই কানাডার ক্যালগরি শহরের বাসিন্দা।
নিজের বিয়ে নিয়ে সুবিক্ষা বলেন, ‘এই সবকিছু আমাদের স্বপ্ন ছিল, কিন্তু কোনোদিন ভাবিনি এটা বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে!’
ক্যালগরিতে বসবাসরত তামিল ব্রাহ্মণ মা-বাবার ঘরে জন্ম সুবিক্ষা সুব্রাহ্মণীর। অন্যদিকে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত টিনা দাসও একটি রক্ষণশীল হিন্দু পরিবার থেকেই উঠে এসেছেন। ছয় বছর আগে ক্যালগরিতে প্রাইড মান্থ উদযাপনের পরপর তাদের দুজনের পরিচয় হয়।
“এতগুলো বছর লড়াই করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার পর শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রিয়জনরা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের বিয়েতে তারা আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন, আনন্দ করেছেন এবং যার যার প্রথা মেনেই বিয়েটা সম্পন্ন হতে সাহায্য করেছেন… ঠিক যেমনটা আমরা চেয়েছিলাম। এর জন্যে আমরা ভীষণ খুশি”, বলেন সুবিক্ষা।
২৯ বছর বয়সী সুবিক্ষা ডেলোয়েটে একজন চার্টার্ড আকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। নিজেকে উভকামী (বাইসেক্সুয়াল) হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন তিনি। উনিশ বছর বয়সে মা-বাবার কাছে প্রথম নিজের অনুভূতির ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলেন সুবিক্ষা।
সুবিক্ষার মা পুর্নাপুশকালা সুব্রাহ্মণী বলেন, “আমি মাদুরাইয়ে বড় হয়েছি এবং পরে কাতারে থেকেছি। তবে কানাডা আসার পরেই শুধু আমি কুইয়্যার কমিউনিটি সম্পর্কে জানতে পারি।” পুর্নাপুশকালা ক্যালগরিতে একটি প্লে স্কুল চালান। তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের প্রথম ভয় ছিল যে- সুবিক্ষার বিষয়টা জানার পর হয়তো ভারতে আমাদের আত্মীয়স্বজনেরা আমাদের এবং আমাদের মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। আর দ্বিতীয় ভয়টা ছিল, সমাজ সুবিক্ষাকে কিভাবে দেখবে এবং সে মাতৃত্বের বিষয়টি কিভাবে গ্রহণ করবে।”
তবে মা-বাবা যাই বলুক, তাতে হাল ছেড়ে দেননি সুবিক্ষা। বরং তাদের প্রতিটি প্রশ্নের যৌক্তিক জবাব দিয়েছেন তিনি। যখন কোনোকিছুতেই পেরে উঠছিলেন না, তখন সুবিক্ষার মা-বাবা কাউন্সেলিংয়ের শরণাপন্ন হন এবং সেখানেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। পুর্নাপুশকালা বলেন, “আমাদের মেয়েই যদি সুখী না হয়, সেখানে আমাদের পরিবারের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার কথা চিন্তা করে কী লাভ?
এদিকে ৩৫ বছর বয়সী টিনা দাস নিজেকে লেসবিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। এর আগে একজন বিষমকামী (হেটেরোসেক্সুয়াল) পুরুষকে বিয়ে করেছিলেন তিনি এবং সেখানে চার বছরের মতো সংসার করেছেন।
ক্যালগরির ফুটহিলস মেডিকেল সেন্টারের পেশেন্ট কেয়ারে কর্মরত টিনা বলেন, “আমার বেড়ে ওঠা মৌলভীবাজারে। ২০০৩ সালে মা-বাবার সাথে আমি মন্ট্রিলে আসি। আমার বোন বিয়ের পর এখানে থাকতে শুরু করে। আমরাও তার ওখানেই থাকতাম। এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায় সম্পর্কে আমার মা-বাবার কোনো ধারণাই ছিল না। তারা মনে করতো, আমার কোনো অসুখ হয়েছে এবং সেজন্যে ১৯ বছর বয়সে আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়। তারা ভেবেছিল এতে করে আমি ঠিক হয়ে যাবো।”
সুবিক্ষা সুব্রাহ্মণীর সাথে সম্পর্ক চার বছরে গড়ালে, টিনার বোন তার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেন এবং পরিবারও তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। কিন্তু তাতে দমে যাননি টিনা। আস্তে আস্তে তিনি নিজের পায়ে দাঁড়ান এবং সুবিক্ষার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যান।
সুবিক্ষা ও টিনার বিয়েতে পুরোহিত হিসেবে ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত ও শিক্ষক সৌরভ বোন্দ্রে। মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত নিয়ে পড়াশোনা করা সৌরভ জানান, এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের কোনো বিয়েতে পৌরহিত্য করলেন তিনি। তবুও তামিল প্রথানুযায়ী বাগদান অনুষ্ঠান, হিন্দু বিয়ের রীতি, দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধন ও পরিবারবর্গের উপস্থিতি- সব মিলিয়ে এই বিয়েটি তার কাছে বিশেষভাবে মনে রাখার মতো।
সৌরভ বলেন, “সময় বদলেছে, এখন অনেক পুরোহিতই এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের বিয়ে পড়াতে কোনো আপত্তি করছেন না। কিন্তু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবলে দেখা যায়, পুরোহিতরা একটি ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করেন, তাদের নেটওয়ার্কিং এর জায়গাও সেটাই। তাই এ ধরনের বিয়ে পড়ালে অন্যদের দ্বারা একঘরে হওয়া বা কাজ হারানোর ঝুঁকিও বেশি থাকে। সুপরিচিত মন্দিরগুলোর প্রধান পুরোহিতেরা চাইলে অন্যদের মধ্যে চিন্তার পরিবর্তন এনে নতুন পরিবর্তনের সূচনা করতে পারেন। কিন্তু তার জন্যে ইচ্ছা তো থাকতে হবে।”
সুবিক্ষা ও টিনার বিয়ের আয়োজন করতে পেরে এবং বৈচিত্র্যময় বিষয় খুঁজে বের করতে পেরে আনন্দিত তাদের ওয়েডিং প্ল্যানার ও আলোকচিত্রীর দলও। আলোকচিত্রী দলের একজন, প্রবীণ পদ্মানভান বলেন, “পরিবার বা প্রথাগত রীতিনীতির ছবিগুলো তো তোলা হয়ই সবসময়। কিন্তু আমরা প্রতিটি বিয়েতেই উপস্থিত মানুষদের আসল অনুভূতি-প্রতিক্রিয়ার মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে চাই। আর এই বিয়েতে সেই সুযোগটা দারুণভাবেই পেয়েছি। বহুদিনের সংগ্রামের পর বিয়ের মাধ্যমে তাদের যে জয় হয়েছে, তা প্রতি মুহূর্তে ফুটে উঠেছে।”
সুবিক্ষার মা পুর্নাপুশকালা জানান, মেয়ের প্রতি তাদের অটল সমর্থনের কারণেই আত্মীয়স্বজনেরা বিয়েতে এসেছেন। সুবিক্ষা মালাবদল করেছেন তামিল ব্রাহ্মণ প্রথানুযায়ী, বাবার কোলে বসে। এমনকি সুবিক্ষার ৮৪ বছর বয়সী দাদি পদ্মাবতীও ছিলেন বিয়ের অনুষ্ঠানে। তার ভাষ্যে, “আমরা চেয়েছি আমাদের সন্তানরা মনে কষ্ট পেয়ে দূরে চলে যাওয়ার বদলে সুখী থাকুক এবং আমাদের পাশেই থাকুক।”
সুবিক্ষা ও টিনার বিয়ে রেজিস্টার করা হয়েছে ক্যালগরিতেই। বিয়ের পরপরই তারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছেন এবং এরপর তারা ক্যালগরিতে ফিরে আসবেন।
সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া