১৯৯৪ সাল। আব্বার চাকরির কারণে আমাদের বসবাস ছিল সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজি ইউনিয়নের দিঘলী গ্রামে। আব্বা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার ছিলেন। তখন দিঘলী গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। ব্যাটারি দিয়ে দু’এক বাড়িতে টিভি দেখা হত, যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। তাও সাদাকালো টেলিভিশন। অ্যান্টেনা দিয়ে টিভি দেখা হত। শুধু বিটিভি। বিশ্বকাপ চলছে, আমাদের বিদ্যুৎ নেই, টিভিও নেই। খেলার ফলাফল মানুষের মুখ থেকেই শুনতে হত। সেমিফাইনালের পর ফাইনাল। টিভি না থাকায় ফাইনালের ফলাফল আগের মতই মানুষের মুখে শোনাই ভরসা। যদিও বিশ্বকাপের কোন খেলা তখন পর্যন্ত টিভিতে দেখা হয়নি।
আমার মামার বাড়ি ছাতক শহরের মন্ডলীভোগ এলাকায়। দিঘলীর পার্শ্ববর্তি গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্ট থেকে গাড়িতে করে আধা ঘন্টার দূরত্ব।
হঠাৎ ফাইনালের দিন সকালে আব্বা বললেন, ফাইনাল খেলা দেখবেন ছাতক মামার বাড়ি গিয়ে। একথা শোনে আম্মাকে দিয়ে আব্বাকে অনুরোধ করালাম সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। প্রথমে একটা ধমক দিলেও পরে রাজি হলেন। দুপুরের দিকে বেবিট্যাক্সি চড়ে গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্ট থেকে ছাতক রওনা হলাম। আধা ঘন্টার মধ্যে ছাতক পৌঁছে গেলাম। রাতে ফাইনাল দেখার অপেক্ষা। মামাদের বাসায় দুইটা টিভি ছিল। ড্রয়িং রুমে সাদাকালো এবং বড় মামার রুমে রঙিন বড় আকারের একটা টিভি। অন্যদের সঙ্গে আমি রঙিন টিভিতে খেলা দেখতে বসলাম। জীবনে প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখা। তাও আবার ফাইনাল খেলা। নাম শোনা দুই দল ব্রাজিল ও ইতালির খেলোয়ারদের টিভিতে দেখছি। আনন্দ আর উত্তেজনার শেষ নেই। তবে এখনকার সময়ের মত টিভি দেখে চিৎকার, চিল্লানির সুযোগ ছিল না। খেলার সময় মামিসহ অন্যরাও দেখলাম বেশি কথা না বলেই খেলা দেখছেন।
দুই দল ফাইনাল খেলছে। একটা দলের পক্ষে তো থাকতেই হবে। রুমে খেলা দেখা সবাই দেখলাম ব্রাজিল সমর্থক। আমি কিছু না বুঝেই ইতালিকে সমর্থন দিলাম। তাও নিরবে। আমি কোন খেলোয়াড়কে চিনি না। চেনার কথাও না। টানটান উত্তেজনার ফাইনাল। দুই দলই মরিয়া হয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য খেলছে। খেলা প্রথমে ড্র হয়। পরে টাইব্রেকারে গড়ায় খেলা। টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে ইতালিকে হারিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে যায় ব্রাজিল। আমার প্রথম সমর্থন করা দল ইতালী হেরে যায়। তবে তেমন মন খারাপ হয়নি। এরপর থেকে ইতালির সমর্থক হয়ে গেলাম। সারা বছর খেলা না দেখলেও বিশ্বকাপ এলে ইতালির খেলা দেখতাম। তবে মাঝে মধ্যে আর্জেন্টিনাকেও সমর্থন দিতাম, খেলা চলাকালীন সময়ে। পরে আমাদের স্থায়ী নিবাস হয় সুনামগঞ্জে।
সুনামগঞ্জ শহরে আমাদের বাসায় ইতালির পতাকাও আমি দুই বিশ্বকাপে টানিয়েছি। তবে পতাকা সংগ্রহ করা ছিল খুব কষ্টকর। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বাদে অন্য দলের পতাকা বাজারে পাওয়া যেত না। গত দুটি বিশ্বকাপে খেলতে পারে নি ইতালি। এজন্য অবশ্য মন খারাপ ছিল। প্রিয় দল বিশ্বকাপে না থাকায় খেলা দেখলেও জোরালো সমর্থন ছিল না কোন দেশের প্রতি। ছয় বার ফাইনাল খেলে চার বার (১৯৩৪, ১৯৩৮, ১৯৮২, ২০০৬) শিরোপা জয় করা এবং সর্বশেষ ২০০৬ সালে ফ্রান্সকে উড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া প্রিয় দলটি আগামী বিশ্বকাপে খেলবে, সে আশায় রইলাম।
- মাহমুদুর রহমান তারেক, যুক্তরাজ্য প্রবাসি সাংবাদিক।