প্রতিবাদে মিছিলে পিতা হারানোর প্রতিক্রিয়া

ঙ্গবন্ধু হত্যার পরে প্রথম প্রতিবাদ এবং মিছিল হয়েছিলো কিশোরগঞ্জে এবং সেটা ১৫ই অগাস্টে। মিছিলটি প্রদক্ষিণ করেছিলো শহরের বেশ কয়েকটি প্রধান সড়ক। ছাত্র ইউনিয়নের সে সময়কার সভাপতি এবং বাকশালের অঙ্গ সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা নূহ-উল-আলম লেলিন এর সাক্ষাৎকার এবং অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণ এটি নিশ্চিত করে। এখানে অধিকাংশ নেতাকর্মীরাই বাম ধারার রাজনীতি বিশেষত সিপিবির সাথে যুক্ত ছিলো।

১৬ই অগাস্ট খুলনার ঐতিহ্যবাহী বি.এল. কলেজে জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা রমেশের নেতৃত্বে মিছিল হয় মিনিট পাঁচেকের জন্য। পুলিশ ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ নিলে সবাই লুকিয়ে পড়ে। অনেকে অবশ্য এ ঘটনা ১৫ই অগাস্ট সকাল ১১টায় বলে উল্লেখ করেন।

সেদিন বিকেলেই ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী মানিক সাহা এবং অন্যান্য অনেকে দেওয়াল লিখন এবং ঝটিকা মিছিলের জন্যে ক্যাম্পাসের পুকুর পাড়ে গেলে পুলিশের ধাওয়ার শিকার হোন। গ্রেফতার হোন সাংবাদিক মানিক সাহা।

অগাস্টেই চট্টগ্রামে মিছিল হয়েছে। সিটি কলেজের নাম উল্লেখযোগ্য। এটা নিয়ে মামলা এবং জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন সে সময়কার অনেক ছাত্রনেতা। তবে দিন তারিখ এবং সময়ের সঠিক হিসেব অনেক সময় পাওয়া যায় নি। চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা এবং মহিউদ্দিন আহমদদের প্রতিরোধ যুদ্ধ একই সুত্রে গাঁথা।

বরগুনা, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, ময়মনসিংহের গফরগাঁও, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে এবং যশোরে ১৫ই অগাস্টের পরে মিছিল এবং প্রতিবাদ সভার প্রমাণ মেলে।

প্রথম গায়েবানা জানাজা আয়োজিত হয় নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। সেখানে প্রতিবাদ সভাও হয়। পুরো জাতি হতবিহ্বল এবং বিমূঢ় হয়ে পড়লেও প্রতিবাদ হয়েছিলো কিছু কিছু স্থানে। বিপরীত চিত্রও আছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর ভয়াবহ পাশবিক উল্লাসে মেতে উঠেছিলো বরিশালের কিছু মানুষ। তারা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদে আনন্দ মিছিল করে। ময়মনসিংহে মিষ্টি বিতরণ করেছিলো বিবেকহীন কিছু মানুষ। অনেকেই বলেছেন স্থানীয় নেতাদের অত্যাচারের থেকে বেঁচে গিয়েছে সে কারণে বরিশালে আনন্দ মিছিল হয়েছিলো।

রাস্তায় রাস্তায় সাজোয়া যান, সেনাবাহিনীর চলাচল এবং অবস্থান নেওয়া এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছিলো। দিনে সেনা টহল, রাতে কারফিউ এবং জাসদের অস্ত্রের ঝনঝনানি উপেক্ষা করে অধিকাংশ স্থানেই আন্দোলন করতে পারেনি বাকশালের নেতাকর্মীরা। চাটুকার চরিত্র এবং সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের অনেকের মুখোশ খুলে যায়। অনেকে নিজ এলাকায় এতটা অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো। সর্বোপরি এমন বিভীষিকাময় হত্যা এবং ভয়ের পরিবেশে সব কিছুই ছিলো এলোমেলো কিন্তু ঘোর কেটে যেতেই বিবেকবান অনেকেই প্রতিবাদ করেছে।

অনেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে এলাকা ছাড়া হয়েছেন। অনেকে জেলে গিয়েছেন। এখন যেমন অনেকের মৃত্যুর পর ফলাও করে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বলা হয় তখন আমার জানতে ইচ্ছে হয় সংগঠক এর ক্রাইটেরিয়া কি? মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পরিচয় অনেক বড়। সব মুক্তিযোদ্ধার নামেই কি সংগঠক শব্দ ব্যাবহার করা যাবে? যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এবং প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে সুবিধা পাওয়ার জন্যে এখন অনেকেই সেই সংগঠক হওয়ার মতোই দাবী করতে পারে যে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিদ্রোহ করেছে, বিপ্লব করেছে। কিন্তু অবশ্যই এগুলো নিয়ে আরও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হওয়া উচিত, সেই সময়ের ইতিহাস আরও বিস্তারিত তুলে আনা উচিত।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে যারাই অগাস্ট মাসে প্রতিবাদ করেছে, বিচার চেয়েছে, জীবনের মায়া ত্যাগ করে মিছিল করেছে তাদের সবাইকে জানাই শ্রদ্ধা। হিমালয় পড়ে গেলে ধূলিকণার কি হবে এটা যারা বুঝতে পেরেছে এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যা মানে বাঙালির স্বাধীনতার উপর আঘাত এটা যারা সেই সময়ে বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

  • ডা. মোহাম্মদ হাসান। চিকিৎসক এবং পেশাজীবি সংগঠক।