রাজধানীর পল্লবীর পাঁচটি পুলিশ বক্সে হামলার ঘটনায় থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু এক সপ্তাহ পার হলেও হামলার ইন্ধনদাতাদের এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তবে গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, এ বিষয়ে গ্রেফতার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী মামলার তদন্ত করা হচ্ছে।
গত ১৪ অক্টোবর সকালে রাজধানীর পল্লবী এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে মিরপুর ট্রাফিক বিভাগ। এ নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক ও এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে। এ কারণে রাজধানীর কালশি ট্রাফিক পুলিশ বক্স, সাগুফতা ট্রাফিক পুলিশ বক্স, মিরপুর ১২ নম্বর ট্রাফিক পুলিশ বক্স, অরিজিনাল ১০ মিরপুর ট্রাফিক পুলিশ বক্স, মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর ট্রাফিক পুলিশ বক্সে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া দায়িত্বরত অবস্থায় রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্যকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধর করে হামলাকারীরা।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র বলছে, পুলিশ বক্সে হামলার ঘটনা পুলিশের মনোবল ভাঙা ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা। এ ঘটনা কাদের নির্দেশে হয়েছে এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছে, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে পুলিশ বক্সে হামলা চালানোর ঘটনা ঘটেছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সামনে রেখে পেছন থেকে কথিত বড় ভাইয়েরা এ ঘটনার নির্দেশদাতা। যারা এ ধরনের ব্যাটারিচালিত অবৈধ রিকশার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং হামলার ঘটনার পেছনে ইন্ধনকারী, তাদের বেশ কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের ধরতে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, হামলাকারীদের সঙ্গে জড়িত ছিল অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশায় চার্জ দেওয়া বিদ্যুৎ সংযোগের অসাধু ব্যবসায়ীরা এবং মটর ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা। বিশেষ করে শারীরিক পঙ্গু ও প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার করে চলে আসছিল এ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশা। ঘটনার সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে জানায় গোয়েন্দা পুলিশ।
তারা আরও জানান, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের কেউ ব্যাটারিচালিত রিকশা চালায় না। তাহলে কীভাবে তাদের এত দ্রুত ম্যানেজ করা হয়েছে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তারা। পরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর হামলা কি না এবং এই পরিকল্পনা কাদের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে, বিষয়টির তদন্ত করা হচ্ছে। শুক্রবার এমনিতেই ছুটির দিন। সকালবেলা কীভাবে তাদের সংগঠিত করা হয়েছিল, সেটিও তদন্ত করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
বেশ কয়েকজন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রাফিক পুলিশের ওপর ক্ষোভ কারণ বিভিন্ন সময় তাদের চাঁদা দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে হয়। ট্রাফিক পুলিশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরলে টাকার বিনিময়ে তারা ছাড় পেতো।
তারা উল্টো অভিযোগ করেন, হাইকোর্ট যদি নিষেধাজ্ঞা দিয়েই থাকেন, তাহলে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন? অবশ্যই এর মধ্যে ঘাপলা রয়েছে। আর এই ঘাপলা হচ্ছে টাকাপয়সা দিয়ে ম্যানেজ।
সেদিনের ঘটনার পরপরই মিরপুর ট্রাফিক বিভাগের এক সার্জেন্ট বাদী হয়ে পল্লবী থানায় মারধর, ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধার অভিযোগে একটি মামলা করেন। এরপর পল্লবী থানা পুলিশ এ ঘটনায় আট জনকে গ্রেফতার করে। পরে থানা পুলিশ থেকে মামলাটি হস্তান্তর করা হয় গোয়েন্দা পুলিশে। বর্তমানে মামলাটি মিরপুর গোয়েন্দা বিভাগ তদন্ত করছে। মিরপুর গোয়েন্দা পুলিশ এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় নয় জনকে গ্রেফতার করেছে।
তবে এ ঘটনার ইন্ধনকারী কারা এবং কী উদ্দেশ্যে এ ঘটনা ঘটেছে, তার এখনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ বলেন, ইন্ধন দেওয়ার কারণেই ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার শুধু মিরপুর নয়, যেসব এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে, সবগুলোই অবৈধভাবে চলছে। যারা এ ধরনের অসাধু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
যে প্রক্রিয়ায় সড়কে চলে ব্যাটারিচালিত রিকশা
চালক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যেক ব্যাটারিচালিত রিকশাচালককে নিতে হয় আলাদা একটি কার্ড। যে কার্ডে লেখা থাকে নাম ও নম্বর। প্রধান সড়ক বাদে অলিগলির মধ্যে চালালে পুলিশ ধরলেই এসব কার্ড দেখানো মাত্রই ছেড়ে দেয়। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের মধ্যে বেশির ভাগই শারীরিকভাবে পঙ্গু প্রতিবন্ধী। আর এসব সুযোগ কাজে লাগিয়েই ফায়দা লুটছে একটি চক্র।
তারা বলছেন, পুলিশের বিষয়টির জন্য যারা কার্ড দেয়, তারাই দেখভাল করে। আর এর জন্য প্রতি মাসে দিতে হয় হাজার টাকা করে। তবে প্রধান সড়কে যেতে মানা। চলতে হয় অলিগলিতে। মাঝেমধ্যে অনেক চালক রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ না থাকার সুযোগে প্রধান সড়কে চলে যায়। তখনই পুলিশের হাতে পাকড়াও হলে আর কোনও কাজ হয় না। ছাড়া পেতে খরচ করতে হয় অনেক টাকা।
অভিযোগ অস্বীকার ট্রাফিক পুলিশের
ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও পুলিশের নজর এড়িয়ে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা রিকশা চালিয়ে থাকে। যখনই নজরে আসে, তখনই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়। কারও বিরুদ্ধে টাকাপয়সা নেওয়ার সুস্পষ্টভাবে অভিযোগ থাকলে জানানোর পরামর্শ দিয়েছে ট্রাফিক বিভাগ।