জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া’র প্রধান শামীন মাহফুজের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। তারা বান্দরবান পাহাড়ি এলাকায় একত্রিত হয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নবাদীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে। তারা সমন্বয় করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলো। পাহাড়ি এলাকায় গত কয়েকদিনে যৌথবাহিনীর অভিযানে জঙ্গিদের এসব কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) মো. আসাদুজ্জামান এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান। রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন হয়। এসময় সিটিটিসি’র সিটি ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার এসএম নাজমুল হক উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে বুধবার রাজধানীর রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করে টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সিটি ইনভেস্টিগেশন বিভাগ। গ্রেফতাররা হলেন- আব্দুল্লাহ (২২), তাজুল ইসলাম (৩৩), জিয়াউদ্দিন (৩৭), হাবিবুবুল্লাহ (১৯) ও মাহামুদুল হাসান (১৮)। এসময় তাদের কাছ থেকে তিনটি মোবাইল ফোন, অন্যান্য জিনিস উদ্ধার করা হয়।
মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এর আগে গ্রেফতার ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালী এই সম্মিলিত জঙ্গি সংগঠনের দাওয়া বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া করার সময় এই মতাদর্শে জড়িয়ে পরেন। পরে শাকির এই সংগঠনের সদস্যদের নিয়মিত চিকিৎসাও দিয়ে আসছিলেন।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানায়, তারা সবাই নব্য উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া’র সক্রিয় সদস্য। এছাড়া গ্রেফতার হাবিবুবুল্লাহ ও মাহামুদুল হাসান ওই সংগঠনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জিহাদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়।
তিনি বলেন, জঙ্গি সংগঠনের সদস্য আবদুল্লাহ, তাজুল ইসলাম ও জিয়াউদ্দিন সংগঠনের সদস্য হিসেবে কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়ে আসা নতুন সদস্যদের সাময়িক বাসস্থানের ব্যবস্থা করতো। এছাড়া ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে হিজরত করা তরুণদের রিসিভ করে ওই আসামিরা আব্দুল্লাহর বাসায় নিয়ে যেতো এবং তাদের উগ্রবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ করতো। পরবর্তীতে তাদের ট্রেনিংয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতো তারা।
সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে সাত জন তরুণ নিখোঁজ হওয়ার পর দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হলে সিটিটিসি ছায়া তদন্ত শুরু করে। কুমিল্লা থেকে হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হওয়া আবরারুল হককে শনাক্ত করে রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে গত ১৩ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়।
আবরারুল হকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেশব্যাপী নিখোঁজের চাঞ্চল্যকর ঘটনার সঙ্গে জড়িত সংগঠনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালীর বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীতে রামপুরার হাজীপাড়া এলাকা থেকে ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালীকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালী জানান, তিনি জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়া’র দাওয়া বিভাগের প্রধান। তিনি সংগঠনের দাওয়াতি বিভাগে কাজ করতেন এবং পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণের সময় কোনও জঙ্গি সদস্য অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা করতেন। কোনও সদস্য হামলার শিকার হলে প্রাথমিক চিকিৎসা কীভাবে করতে হবে সে বিষয়েও প্রশিক্ষণ দিতেন। সমতলে থাকাকালেও তিনি যেসব জঙ্গি সদস্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের সময় অসুস্থ হতেন তাদের গোপন চ্যাটে আলাপ করে চিকিৎসা করতেন।
ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালী পাহাড়ি জঙ্গি ক্যাম্পে এক মাসের বেশি সময় অবস্থান করেছেন। প্রতিমাসে একবার তিনি পাহাড়ি ক্যাম্প পরিদর্শন করতেন। এর পাশাপাশি জঙ্গি নেতা শামীম মাহফুজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
যেভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো
ক্যাম্পে তিন ভাগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো বলে জানা গেছে। প্রথম ভাগে পাহাড়ের ক্যাম্পে শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। দ্বিতীয়ভাগে যুদ্ধ কৌশল যেখানে ডামি অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। তৃতীয় ধাপে পেট্রলিং শেখানো হতো।
ট্রেনিং ক্যাম্পটিতে শামীম মাহফুজের পাশাপাশি তমাল, রনবীর, রাকিব, ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালী যাতায়াত করতেন এবং সার্বিক বিষয় তদারকি করতেন। ক্যাম্প থেকে কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাইলে তারা বিদ্রোহীদের হাত, পা, চোখ বেঁধে বন্দি করে রাখতেন।
সংগঠনের উদ্দেশ্য
জঙ্গিবাদের জন্য সদস্য রিক্রুটমেন্ট, অর্থ সংগ্রহ, সশস্ত্র সামরিক ট্রেনিং, আধুনিক অস্ত্র কেনাসহ বিশাল জঙ্গি বাহিনী গঠন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এসব উদ্দেশ্য পূরণ করতে তারা দেশব্যাপী ২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৭০ থেকে ৮০ জন যুবককে এই সংগঠনের সদস্য করেছেন।
সংগঠনের উদ্দেশ্যে ছিল পাহাড়ে তাদের শক্ত অবস্থান তৈরি, নিরাপদ সামরিক ট্রেনিং, সংগঠনের উগ্রবাদী উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দেশে নাশকতা সৃষ্টির মাধ্যমে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী রাজধানীর ডেমরা থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।