পাঠ্যবইয়ে নানান ‘ভুল’ ও ‘অসঙ্গতি’ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা; যা উঠেছে সংসদ অধিবেশন পর্যন্ত। অবশ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিবর্তনবাদ নিয়ে ‘মিথ্যা তথ্য’ পরিবেশন করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং নির্দিষ্ট কিছু গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। যদিও ইতোমধ্যেই ২০২৩ সালের শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বই প্রত্যাহার করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলা হয়েছে, এই দুটি বই প্রত্যাহারসহ আরও তিনটি বইয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। তবে অন্য তিনটি বইয়ের কোন কোন অধ্যায়ে সংশোধন হচ্ছে তা নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। জানা গেছে, প্রত্যাহার করা বইয়ে থাকা বিবর্তনবাদের অংশ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি। কিছু অংশ সংশোধন এবং কিছু অংশ বাদ দিয়ে বইগুলো নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করা হবে।
শিক্ষাক্রম ঘেঁটে দেখা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ এবং ‘বিজ্ঞান’ বিষয়ে দুটি করে বই আছে। এর এক অংশের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অনুশীলন বই’ ও অপর অংশের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অনুসন্ধানী পাঠ’। এর মধ্যে দুটি শ্রেণিতেই ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটি আর পড়ানো হবে না।
এনসিটিবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বই দুটি প্রত্যাহারের পাশাপাশি ওই দুই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলন বই’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের কিছু অধ্যায়ের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। এই তিনটি বইয়ে (প্রত্যাহার দুটি ছাড়াও) যেসব অধ্যায় সংশোধন করা হবে, সেসব বাদে বাকি অধ্যায়গুলো পাঠদান অব্যাহত থাকবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। বইগুলোতে কী কী সংশোধনী রয়েছে, তা শিগগিরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবহিত করা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
এদিকে বই প্রত্যাহার ও সংশোধনের বিষয়ে কথা বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শুক্রবার চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু জিনিস নিয়ে লোকজন বলছেন, এটা না থাকলে ভালো হতো বা এটা অনেক বেশি লিখেছে। তাই আমরা নতুন বই আবার প্রণয়ন করে দেবো।’
তিনি এসময় আরও বলেন, ‘ধর্ম একটা পবিত্র জিনিস। এটা নিয়ে কি মিথ্যা কথা চলে? যারা এই মিথ্যাচার করে তাদের কথা বিশ্বাস করবেন না। বইয়ের মধ্যে কী আছে, নিজেরা পড়ে দেখবেন, তারা কি বলে—সেটা বিশ্বাস করবেন না।’
বই প্রত্যাহারের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন দুটি বই প্রণয়ন করে দেবো। এখন থেকে ওই বই দুটি পড়ানো বন্ধ থাকবে। ওই বিষয়ের (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান) দুইটা করে বই। একটা করে পড়ানো বন্ধ থাকবে। ওটা পড়ার দরকার নাই। বইয়ে ইসলামবিরোধী কিছুই নাই, তারপরও আমরা মানুষের কথা শুনি।’
যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে, তার মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের ২১ ও ২৪ নম্বর নম্বর পৃষ্ঠায় আলোচিত ‘বিবর্তনবাদ’ অংশ নিয়ে বিতর্ক ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে। ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বই নিয়ে অপপ্রচার করে বলা হয়, ‘মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি’। অথচ বইটির ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে?’ অধ্যায়ের ৮ নম্বর লাইনে বলা হয়েছে ‘অনেকে বলেন, মানুষের উদ্ভব নাকি বানর থেকে। এ কথা ভুল।’
বইটির বইটির ২৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘প্রাইমেট জাতীয় প্রাণি থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে একদিকে শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাংওটাং, গিবনের মতো এপ-জাতীয় প্রাণীরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। অন্যদিকে বানর তৈরি হয়েছে। আর একটি ধারায় মানুষ ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে নানান পর্যায়ে। তোমাদের মনে রাখতে হবে বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি।’
অন্যদিকে আর ষষ্ঠ শেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের অনুশীলন বইয়ে ‘খুশি আপা’ গল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। বইটির ১১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘নিসর্গ’ প্রশ্ন করছে ‘খুশি আপা’কে। অংশটুকু তুলে দেওয়া হলো— ‘নিসর্গ: আমি শুনেছি, আমাদের আদি পুরুষ নাকি বানর ছিল। খুশি আপা হেসে বললেন: তাই নাকি? অনেকে মনে করে, বানর আমাদের পূর্বপুরুষ। কিন্তু তথ্যটা সঠিক নয়। বানর আমাদের পূর্বপুরুষ নয়।’
এছাড়া সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ৫১ ও ৫২ পৃষ্ঠার ট্রান্সজেন্ডার বিষয় আলোচনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক তোলা হয়।
পাঠ্যবইয়ে বিবর্তন নিয়ে মানুষের ভুল জানার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হলেও অপপ্রচার করে বিতর্ক তৈরি করা হয়। ‘বিবর্তনতত্ত্ব’ পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়ারও দাবি তোলা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এসব বিতর্ক এড়াতে শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) এনসিটিবি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ নামে দুটি বই পাঠদান থেকে প্রত্যাহার করা হলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে জরুরি বৈঠক করে এনসিটিবি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ নামে দুটি বই পাঠদান থেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে পাঠ্যবই থেকে ‘বিবর্তনবাদ’ এর অংশ নিয়ে বিতর্ক ওঠায় সংশ্লিষ্ট অংশটুকু বাদ দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে দুটো অংশ রয়েছে; আর বিজ্ঞান বইয়েও দুটো করে অংশ রয়েছে। একটা ‘অনুশীলন বই’, আরেকটা ‘অনুসন্ধানী পাঠ’। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ স্থগিত করা হয়েছে। আর ‘অনুশীলন বই’য়ের কিছু কিছু অধ্যায়ের কিছু জায়গায় সংশোধন করে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
বিবর্তনবাদের বাইরে আর কোনও সংশোধনী আছে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, মিশরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতাগুলো এসেছে, প্রাচীন দেব-দেবী নিয়ে কথা এসেছে। বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বৈঠকে আমরা আলোচনা করেছি একটি হচ্ছে প্রাচীন দেব-দেবী নিয়ে প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে বেশি কথা বলা হচ্ছে, আমাদের ইতিহাসটা কম। আর তাছাড়া ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির প্রাচীন সভ্যতার নাম-ধামগুলো বাচ্চাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। সেগুলো নবম ও দশম শ্রেণির দিকে নিয়ে গেলে ভালো হয়।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন কর্মকর্তা বলেন, বিবর্তনবাদ সংশোধন করা নয়, এটি পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হবে।