বর্তমান বিশ্বে পর্যটন শিল্প সেবাখাতের অন্যতম এবং একক বৃহত্তম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। শিল্পটি তার বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পর্যটনের ওপর ভিত্তি করে সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্বের অনেক দেশ। বাংলাদেশেও এর অপার সম্ভাবনা রয়েছে। যুগে যুগে পর্যটন খাত ব্যাপক বিকাশ লাভ করেছে, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র। তবে স্বাধীনতার ৫১ বছরে পর্যটনে বিকাশ ঘটলেও কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সময়ের প্রেক্ষিতে অতি জরুরি নানাবিধ শিল্প ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পর্যটনকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৭ নভেম্বরই তিনি বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন, প্রসার, বিকাশ, বিদেশে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা, অভ্যন্তরীণ পর্যটন অবকাঠামো সৃষ্টি এবং পর্যটন বিষয়ক প্রশিক্ষণ চালুসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং-১৪৩ বলে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। আর অপার সম্ভাবনাময় দেশের পর্যটন শিল্পকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের উদ্দেশ্যে এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ‘পর্যটন গন্তব্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় পর্যটন সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) গঠন করা হয়।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো সব পর্যটন আকর্ষণীয় উপাদান বাংলাদেশে বিদ্যমান। তবে পর্যটনে বড় সমস্যা যাতায়াত। বর্তমানে অনেক রাস্তা পাকা হয়েছে, কিন্তু যেখানে সমস্যা হয় সেখানে সঠিকভাবে সমন্বয় করা হয় না। এছাড়া পর্যটন এলাকার নিরাপত্তাসহ আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। পর্যটন এলাকায় গুরুত্ব দিয়ে রাস্তা মেরামতসহ আনুষঙ্গিক কাজ করা গেলে এ সমস্যা থাকে না।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন ব্যাপক হারে বেড়েছে। এক থেকে দেড় কোটি মানুষ এখন দেশের অভ্যন্তরেই ঘুরছেন। এছাড়াও খাবার কেন্দ্রিক কিছু পর্যটনের বিকাশ হয়েছে। তবে স্বাধীনতার ৫১ বছরে দেশের পর্যটন আরেও বেশি বিকশিত হতে পারতো। তবে নানা প্রতিকূলতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে সেটি আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
তাদের মতে, নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিচিত্র জীবনধারা, আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং প্রত্ন সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন গন্তব্য। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ একক ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন; পৃথিবীর দীর্ঘতম অখণ্ড বালুকাময় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার; পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় জীবনধারা ও সংস্কৃতি; দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ফসলের মাঠ; অসংখ্য হাওড়, বিল, নদ-নদী; সিলেট অঞ্চলের সারি সারি চা বাগান ও জলাবন এবং সর্বোপরি এ দেশের মানুষের মুখের অকৃত্রিম হাসি পৃথিবীর যেকোনো দেশের ট্যুরিস্টকে আকর্ষণ করতে সক্ষম। তারপরও কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারা দুঃশ্চিন্তার কারণ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উপব্যবস্থাপক (বিপণন) মোহাম্মদ শেখ মেহদি হাসান বলেন, পর্যটন শিল্প প্রত্যাশার জায়গায় আসতে পারেনি। কিন্তু পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের রাজস্ব আয়ে ভূমিকা রাখতে যে ধরনের উপাদান দরকার তার সবই আছে। আমাদের নানা সীমাদ্ধতা আছে। থাইল্যান্ডে দেখা যায় ছোট একটা বিচের মধ্যে সবাই নিজ নিজ অ্যাকটিভিটিজ (কার্যক্রম) করছে। আমাদের কক্সবাজারে অপরূপ সৌন্দর্য রয়েছে। তবে বিদেশি পর্যটকদের জন্য অনেক কিছু প্রয়োজন। তাদের ট্যুরিস্ট লাইফ শুরু হয় বিকেল থেকে, চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। কিন্তু কক্সবাজারে সেই ধরনের ট্যুরিস্টদের জন্য কোনো অ্যাকটিভিটিজ নেই। সব ধরনের পর্যটকের জন্য সব আয়োজন রাখতে না পারলে ট্যুরিস্ট আসবে না।
তিনি বলেন, কক্সবাজার সি-বিচে (সমুদ্র সৈকত) কোনো একজন নারী বিদেশি পর্যটক সূর্যস্নান করতে চাইলে সেটি কিন্তু পারবে না, সে ধরনের স্থান আমাদের নেই। এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারিনি সূর্যস্নানের জন্য। কিন্তু তারা বিচে আসবেই সূর্যস্নানের জন্য, কারণ এটা তাদের শরীরে জন্য প্রয়োজন। বিদেশি পর্যটকদের জন্য অ্যালকোহলি বেভারেজের সহজলভ্যতা প্রয়োজন, সেটা তাদের জীবনের অংশ। আমাদের এখানে সেটিকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয় এবং এটির কোনো লিগ্যাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম নেই। তাই অনেকটা অবৈধভাবে এসব কিনতে হয়। এছাড়া নিরাপত্তার ঝুঁকিও কিন্তু রয়েছে। আমাদের যথাযথ ব্র্যান্ডিংয়ের ঘাটতি রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের দিকে নজর দেওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদেশি ট্যুরিস্টদের জন্য ৫০ বছর কাটিয়ে দেওয়া ভুল ছিলে। আমাদের অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের সেবা নিশ্চিতে সেভাবে ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। এখন গ্রুপে গ্রুপে মানুষ ঘুরতে যাচ্ছে। মেয়েরা বান্দরবানের গহীন এলাকায়ও ঘুরতে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বেড়ানোর ব্যাপারটা তীব্রভাবে কাজ করছে। সেক্ষেত্রে ভ্রমণটা সহজলভ্য করতে পারলে সেটি পর্যটনের বিকাশে ভূমিকা রাখবে। ট্যুর গাইডদের নির্দিষ্ট রেগুলেশনে (নিয়ম) আনা উচিত। দেশের মানুষ সবাই যে বিদেশ যেতে চাইবে ব্যাপারটা এমন নয়, অনেকেই দেশে ঘুরতে চায়। কী কী সমস্যা আছে সেগুলো যদি সমাধান করা যায়, তাহলে পর্যটন অনেকটা বিকশিত হবে।
বিকাশমান পর্যটন শিল্প বড় ধাক্কা খায় করোনাকালে। এসময় গোটা বিশ্বের পর্যটন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশেও এর প্রভাব ছিল ব্যাপক। কোভিডের প্রভাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পর্যটন শিল্প। এখনো সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই শিল্প। কোভিডের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ ও দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তা থেকে কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মাধ্যমে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এক্ষেত্রে করোনার ক্ষয়ক্ষতি থেকে উত্তরণের জন্য পর্যটন উপখাতগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা, সহজ ঋণ ব্যবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন, পর্যটন কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার কারণে পর্যটন খাতে মোট মূল্য সংযোজনে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন টাকার ক্ষতি হয়েছে। পর্যটন পরিবহন উপ-খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যা মোট ক্ষতির ৪০ শতাংশ। আর হোটেল, রিসোর্ট এবং রেস্তোরাঁ উপখাতে যথাক্রমে ২৯ এবং ২৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। আর এই খাতে চাকরি হারিয়েছেন ১৪০ হাজার শ্রমিক। করোনাকালে হোটেল এবং রিসোর্টে গড়ে ৩৪ শতাংশ, ট্যুর অপারেটর গড়ে ৩৪ শতাংশ এবং ট্রাভেল এজেন্টদের গড়ে ২৬ শতাংশ মজুরি এবং বেতন কমেছে। পাশাপাশি এই সেক্টরের কর্মীদের জন্য আনুষঙ্গিক ৫০ শতাংশ সুবিধা কমেছে।
এদিকে দেশের পর্যটনের উন্নয়নে বেশ কিছু পরিকল্পনা করেছে ট্যুরিজম বোর্ড। বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার রূপরেখাও নির্ধারণ করেছে এই বোর্ড।
ট্যুরিজম বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, পর্যটনের উন্নয়নে বোর্ডের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- টেকসই পর্যটন উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করা; ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যটন আকর্ষণের প্রচার ও বিপণন; পর্যটন খাতে নতুন কর্ম সৃজনের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ; গ্রামীণ পর্যটনের বিকাশ এবং ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের জন্য জনগণকে পর্যটনের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ; পর্যটনের জন্য মৌলিক সুবিধা সম্প্রসারণ; উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে পর্যটনকে সম্পৃক্ত করতে সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সমন্বয়; দেশি ও আঞ্চলিক পর্যটনের বিকাশে আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যটন সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়; বাজার, পণ্য এবং সেবার বহুমুখীকরণ ও বৈচিত্র্য আনয়ন এবং জনশক্তির চাহিদা নিরূপণ, দক্ষতা উন্নয়ন, নতুন কর্মের সুযোগ তৈরি ও সরবরাহ নিশ্চিত করা।
পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রস্তুতের জন্য ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর আইপিই গ্লোবাল লিমিটেড (IPE GLOBAL LTD) নামের একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পর্যটন মহাপরিকল্পনাটি পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে আগামী ২৫ বছরের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নির্দেশ করবে। মহাপরিকল্পনাটি ২০৪০ সাল নাগাদ ১০ মিলিয়ন পর্যটন আগমনের মাধ্যমে ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্য নিয়ে প্রণয়ন করা হবে। এটি বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ অর্জন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা রাখবে।
ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, বাংলাদেশে পর্যটন অগ্রসর হচ্ছে। এটি একটি বিকাশমান শিল্প। জাতীয় শিল্পনীতি-২০২২ এর খসড়া প্রণীত হয়েছে, সেখানে ১২টি উপখাতের অধীনে শতাধিক কর্মকাণ্ড পর্যটন খাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেখানে ১০টি অগ্রাধিকার শিল্প চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে পর্যটনের অবস্থান তৃতীয়। ইতিপূর্বে আমরা পর্যটনকে শিল্প হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি, তাই এখন যেটি হয়েছে সেটিও অগ্রগতি। যে মাস্টারপ্ল্যানের কথা বলছি তা আশা করি ডিসেম্বরে শেষ হবে, এরপর অ্যাকশন প্ল্যান করবো যাতে করে অতিদ্রুত আমাদের যে ১ হাজার ৫১টি পর্যটন আকর্ষণ চিহ্নিত করেছি, এর মধ্যে কমপক্ষে ৫০টিকে আমরা চেষ্টা করবো আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে। সেখানে সরকারি এবং দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে। আশা করি এটি করতে সক্ষম হবো এবং পর্যটন একটি নতুন মাত্রা পাবে।
তিনি আরও বলেন, যদি আমরা মনে করি পর্যটনের উন্নয়ন শুধু ট্যুরিজম বোর্ড বা পর্যটন করপোরেশনের কাজ তাহলে কিন্তু চলবে না। পর্যটনের উন্নয়ন একটা সামগ্রিক বিষয়, সেখানে সবার ভূমিকা আছে। আমরা যদি পর্যটন বান্ধব হই এবং নিজ নিজ জায়গা থেকে মানুষ যদি দেশকে ব্র্যান্ডিং করে, সেটি পর্যটনে অনেক ভূমিকা রাখবে। আমরা মনে করি এটি আমাদের সবার কাজ।
সূত্র : জাগো নিউজ