কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে পদ্মা সেতু এলাকা। আগামী ২৫ জুন সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি সেতু এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে র্যাব, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। অপরাপর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পুরো সেতু এলাকায় সেনা সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন। সেতুর ওপর-নিচে উভয় স্থানই নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। আশপাশের সড়কে এবং সড়কের বাইরেও বসানো হচ্ছে ক্লোজ সার্কিট (সিসি টিভি) ক্যামেরা। মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশস্থল এবং জাজিরায় জনসভাস্থল ঘিরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের কঠোর নজরদারি চলছে। পদ্মা নদীতেও চলছে টহল। আগামী ২৫ জুন পর্যন্ত চলবে এই নিরাপত্তা কার্যক্রম।
সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই পাঁচ স্তরের নিরাপত্তার আওতায় আনা হবে দুই পাড়ের পুরো এলাকা। ইতোমধ্যে দুই পাড়ে ‘পদ্মা সেতু উত্তর’ ও ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণ’ নামে নতুন দুটি থানার নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। থানাগুলো তদারকি করবেন দুজন সহকারী পুলিশ সুপার। ২৪ ঘণ্টাই নদীতে স্পিডবোট দিয়ে টহল দেবে নৌ-পুলিশ। এছাড়া থাকবে হাইওয়ে পুলিশও। পুলিশ ও সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যদের তদারকি করবে সেনাবাহিনী। যেকোনও গুজব ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কঠোর নজরদারি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেতু এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে পেলেই তাকে আটক জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
এদিকে সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সব অংশ এবং পুরো সেতু এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকে পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। পদ্মার দুই পাড়ে নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনাও দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জানা গেছে, উদ্বোধনী দিনের আগের রাত থেকে সেতুর নিচ দিয়ে অর্থাৎ পদ্মা নদী দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হবে। সেতুর দুই পাড়ে প্রধানমন্ত্রী সেতু উদ্বোধনীর সব কর্মসূচি শেষ করে রাজধানীতে ফেরার উদ্দেশে মুন্সীগঞ্জ সীমানা ত্যাগ না করা পর্যন্ত নদী দিয়ে নৌযান এবং সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখা হতে পারে।
সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ বর্তমান সরকারের একটি বড় সাফল্য। এ সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকারবিরোধী একটি চক্র এবং দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহল নানা অপপ্রচারে লিপ্ত। মহলটি জনগণকে বিভ্রান্ত করতে এবং একইসঙ্গে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে সারা দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মধ্যে উৎসবের আমেজ দেখা যাচ্ছে। এই উৎসবমুখর পরিবেশকে ম্লান করে দিতে এবং জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে দেশে নাশকতা সৃষ্টির মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির অপচেষ্টা চলছে বলেও জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা, যা প্রধানমন্ত্রী নিজেও বারবার বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে সরকারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানিয়েছেন, যখনই জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় থাকে তখনই কমিটির পক্ষ থেকে বিষয়টি সরকারের নজরে আনি। পদ্মা সেতু যেহেতু বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের একটি যুগান্তকারী মাইলফলক, তাই এটিকে ঘিরে যাতে কোনও অপশক্তি তৎপর হতে না পারে সে বিষয়ে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির নজরদারি রয়েছে।
আগামী ২৫ জুন বহুল প্রত্যাশিত এই সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা-উপজেলায় এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এ উপলক্ষে জাজিরায় জনসভার আয়োজন করা হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই জনসভায় অন্তত ১৫ লাখ মানুষের সমাগম ঘটবে। ওই জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষণ দেবেন। জনসভা ও নিরাপত্তা নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা। সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে পুলিশসহ নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সবকটি সংস্থার পক্ষ থেকে। পুলিশ সদর দফতরে আইজিপির নেতৃত্বে বৈঠক করেছেন ঊর্ধ্বতনরা। পুলিশের পক্ষ থেকে সেতুর নিরাপত্তায় দুই পাড়ে থানার পাশাপাশি নৌপথেও পাহারা বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দুই পাড়ে দুটি থানার কাজ শেষ হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই থানাগুলোর বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করার কথা রয়েছে। রাজধানী ঢাকা থেকে দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা সেতুস্থল পরিদর্শন করছেন। নৌযানে নদীতেও টহল চলছে।
পুলিশ সদর দফতরের ওই কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এই মাহেন্দ্রক্ষণকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্রকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বি এম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক নিহত ও দুই শতাধিক আহত হওয়া, রাজধানীতে বাসে আগুন, রাজধানীর বাইরে ট্রেনে আগুন লাগার মতো ঘটনাও ঘটেছে। সেতু উদ্বোধনের আগেই এ ঘটনাগুলো কোনও স্যাবোটাজ কিনা পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সেতুর নিরাপত্তায় দুই পাশে দুটি নতুন থানা গঠন করা হয়েছে। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে থানা ভবন। সেতুর মুন্সীগঞ্জের লৌহজং প্রান্তের থানাটির নাম ‘পদ্মা সেতু উত্তর থানা’ ও শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্ট প্রান্তটির নাম হচ্ছে ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা’। শুধু সেতু নয়, দুই পাড়ের মানুষের নিরাপত্তা দেবে থানা দুটি। প্রায় ৩২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়ে চারতলা ভবন দুটি নির্মাণ করেছে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ। একজন সহকারী পুলিশ সুপারসহ ৪০ জন করে পুলিশ সদস্য থাকবেন প্রতিটি থানায়। সংযোগ সড়কের টোল প্লাজার পাশে থানা ভবনের অবকাঠামো নির্মাণ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। সেতুর দুই প্রান্তেই দুটি করে ইউনিয়ন এই থানা দুটির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। লৌহজংয়ের মাওয়া প্রান্তের থানার আওতায় থাকবে মেদিনীমণ্ডল ও কুমারভোগ ইউনিয়ন। জাজিরা পয়েন্টের থানার আওতায় থাকবে পূর্ব নাওডোবা ও পশ্চিম নাওডোবা ইউনিয়ন।
এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন, শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুজ্জামান এবং মাদারীপুরের পুলিশ সুপর গোলাম মোস্তফা রাসেল জানিয়েছেন, ২৫ জুনের সব কর্মসূচিকে সফল করতে কাজ করছি। পুলিশ সদর দফতর থেকেও সার্বক্ষণিক খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। বড় আকারের জনসভাসহ সেতুর দুই পাড়ে প্রধানমন্ত্রীর ৫টি কর্মসূচি রয়েছে। তাই কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখা হয়েছে পুরো সেতু এলাকা। সেতু সংশ্লিষ্ট তিন জেলাসহ বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা পুলিশও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে।