নাশকতার পরিকল্পনা ‘নিরুদ্দেশদের’, প্রস্তুতি নিয়েছে র‌্যাব

কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৫৫ জনের বেশি কিশোর এবং তরুণ নিরুদ্দেশ রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হলেও অনেকেই রয়েছে অধরা। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নেতারা পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন জায়গায় সেসব কিশোর তরুণদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তারা এখন প্রস্তুতি নিচ্ছে গেরিলা হামলার। যেকোনও সময় যে কোনও জায়গায় ঘর ছাড়া এই তরুণরা হামলা চালাতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সম্প্রতি নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের ২৬ জন সদস্যকে গ্রেফতারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছে র‌্যাবের অভিযানিক দল।

হরকাতুল জিহাদ (হুজিবি), জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের বেশ কিছু সদস্য ২০১৭ সালে নতুন একটি উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নামকরণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। হুজিবি, জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম নিষিদ্ধ হওয়ায় নিষিদ্ধ সংগঠন থেকে সদস্য সংগ্রহ ও অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। সেকারণে তারা সংগঠন হতে বের হয়ে নতুন এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। প্রাথমিকভাবে উগ্রবাদী এই সংগঠনের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কোমলমতি তরুণদের টার্গেট করে। তাদের বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ ভিডিও এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করা হতো। তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করে তুলতে বিভিন্নভাবে মোটিভেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

গ্রেফতারকৃতদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী র‌্যাব জানতে পারে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণের সংখ্যা ৫৫ এর অধিক। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নিখোঁজ তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সদস্যের তত্ত্বাবধানে সেইফ হাউজে রাখা হতো। প্রশিক্ষণকালীন বিভিন্ন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে রেখে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হত। এছাড়াও, আত্মগোপনে থাকার কৌশল হিসেবে তাদের রাজমিস্ত্রি, রঙ মিস্ত্রি, ইলেক্ট্রিশিয়ানসহ বিভিন্ন পেশার কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো।

র‌্যাব বলছে, চার ধরনের পরিবেশ চিহ্নিত করে গেরিলা যুদ্ধ কিংবা গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিরা। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে ঘরছাড়া সেসব তরুণও। বনভূমি, পাহাড়ি ভূমি, মরুভূমি ও জনভূমি; এই চারটি এলাকার ভৌগলিক অবস্থান বিভিন্ন তথ্য বিচার বিশ্লেষণ করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। বাংলাদেশে মরু অঞ্চল না থাকলেও মরুভূমিতে যুদ্ধ করাটা কষ্টসাধ্য। আর আল-কায়েদাসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠিত জঙ্গি সংগঠন মরুভূমিতে যুদ্ধ করেছে। এটা এখানকার জঙ্গিরা একটি উদাহরণ হিসেবে নিয়ে সে ধরনের প্রস্তুতির চেষ্টা করেছে।

অভিযানে উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করে র‌্যাব বলছে, কথিত সেই হিজরতে পাঠানোর আগে এই তরুণদের ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। সেই সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়গুলো বিবেচনা করেই রিক্রুট করা হতো। সদস্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনও সমস্যা আছে কিনা ডাক্তার দেখাতে হবে কিনা; এসব বিষয়ে তাদের নজর থাকতো। ২০ কেজি পর্যন্ত মালামাল বহন করা সেই সাথে দৈনিক ছয় থেকে আট ঘণ্টা হাঁটার সক্ষমতা থাকাদের দলে নেওয়া হতো।

‘হিজরতে’ আসার এক মাস আগে থেকেই নির্বাচিতদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কোনও ধরনের যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো না বলেও জানিয়েছে র‌্যাব। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, এমনকি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে অস্বাভাবিক কথাবার্তা বা কোনও ধরনের আলোচনাও করতে দেওয়া হতো না। দীর্ঘ সময় দূরে থাকার কারণ সম্পর্কে পরিবারের কাছে ব্যাখ্যা দিয়ে আসতে বলা হতো। হিজরতকালে কোনও ধরনের অডিও-ভিডিও না রাখার ব্যাপারে সোচ্চার তারা। যেন কেউ গ্রেফতার বা ধরা পড়লে যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের হিজরতের কথা জানতে না পারে। এজন্য মোবাইল সিকিউরিটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকার বিষয়টিও তারা নজর রাখতো।

গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব আরও জানায়, অনেকেই এখন পর্যন্ত নিরুদ্দেশ রয়েছে, আত্মগোপনে রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ধরে নেওয়া হয়েছে যে কোনও সময় যে কোনও ধরনের অনাকাঙিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে। পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এবং গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জঙ্গিবাদ এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেও দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে যেকোনও মুহূর্তে যে কোনও স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধনে উদ্বুদ্ধ হয়ে নাশকতা করতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এ ধরনের প্রস্তুতির কথা চিন্তা করেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় এখনও অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যারা স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়েছে ৫৫ জনের যে তালিকা তাদের শনাক্ত করা আইনের আওতায় আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যেকোনও ধরনের নাশকতা কিংবা সহিংসতায় অংশ নেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সংগঠনের যারা উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছে তাদের নির্দেশনা পেলে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের যে কোনও জায়গায় নাশকতার প্রস্তুতি তারা নিচ্ছিল। সংগঠনের জন্য আরও সদস্য রিক্রুট করা, হিজরতের নামে প্রশিক্ষণ দেওয়া, সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করা এসব পরিকল্পনা নিয়ে তারা সামনের দিকে এগোচ্ছিল। আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে, আমরা সজাগ রয়েছি। আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন