করোনা পরিস্থিতি, বন্যা ও দেশের সামগ্রিক অবস্থার কারণে সিলেটে কমেছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগের মতো অনুষ্ঠান আয়োজনে আয়োজকদেরও খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে এর প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা। আর এতে করে আমাদের চিরচেনা সংস্কৃতি থেকে দিন দিন দূরে সরে যাওয়ার একটা অবস্থা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন সংস্কৃতিকর্মীরা।
সিলেটের নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নগরনাট এর সাধারণ সম্পাদক অরূপ বাউলের মতে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যারা আয়োজন করে বা যারা সংগঠন করে তাদের অধিকাংশই কিন্তু শিক্ষার্থী। করোনাকালে তাদের মধ্যে একটা বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে দলগুলো ভেঙে গেছে বলা যায়। যার ফলে রিহার্সেল হচ্ছে না। কর্মী সংকটও দেখা দিয়েছে। এটা গেল একটা কারণ। পরবর্তী কারণ হিসেবে বলবো সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি। এর সাথে মানুষের অভাব-অনটনের যোগসূত্র রয়েছে। তারপর রাজনৈতিক একটা বিষয় আছে। দেখা গেছে বিভিন্ন আয়োজনে এখন প্রশাসনের দিক থেকে আগের মতো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
তাছাড়া আগে যেভাবে স্পন্সর পাওয়া যেত, এখন সেটা পাওয়া যায় না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মূলত স্পন্সর নিয়েই করা হয়ে থাকে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তো আর নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে কোনো আয়োজন করে না। বিভিন্ন জায়গা থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে বা স্পন্সর নিয়ে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এখন তো মানুষের হাত খালি। সেসব চিন্তা থেকে কোনো আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া যায় না। সেজন্য বলবো অর্থনৈতিক বিষয়টি একটি প্রধান কারণ বলা যায়।
তিনি বলেন, ‘এর ফলে আমরা সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে পড়ছি। এতে করে একটা প্রজন্ম সংস্কৃতিবিমুখ হয়ে বেড়ে উঠছে। যা সমাজের জন্য অশনি সংকেত বলা যায়।’
তিনি আরও বলেন, আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। আগে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সমস্যায় সংস্কৃতির ভাষায় প্রতিবাদ জানাতো। এখন তা হচ্ছে না বা তারা পারছে না।
জানা গেছে, গত ৩ বছরে সিলেটের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মী কমে গেছে। এর মধ্যে অনেকে স্টুডেন্ট ভিসায় দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে। এছাড়া বর্তমানে সংস্কৃতি চর্চাটাকে ‘হারাম’ হিসেবে উপস্থাপন করে বিভিন্নভাবে কর্মীদের এসব থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ারও একটা চেষ্টা চলছে।
নাট্য সংগঠন লিটল থিয়েটার, সিলেটের কর্মী উজ্জ্বল রায় বলেন, যদি সংস্কৃতিকর্মীদের কথা বলি তাহলে বলবো বর্তমানে সংস্কৃতি অঙ্গনে কাজ করার মতো কর্মী খুঁজে পাওয়া যায় না। সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রত্যেকটি সংগঠনের কার্যক্রম দিন দিন শূন্যের কোটায় চলে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে সবকিছুতে একঘেয়েমি আসার কারণেই মূলত প্রেক্ষাপটটা হঠাৎ করে বদলে গেছে। এর ফলাফলটা খুব জঘন্য রূপ ধারণ করছে। মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলছে। মানুষ যে স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠত, মানুষের মধ্যে যে মানবিকতাটা জাগত, সেটা এখন আর জাগে না।
তিনি বলেন, সংস্কৃতিচর্চার অবস্থা আগের জায়গায় নিতে হলে কয়েকটি ক্ষেত্র, যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিকও সাংস্কৃতিক সংগঠন, খেলাধুলার ক্লাবগুলোকে আবার সতেজ করতে হবে, জাগিয়ে তুলতে হবে। সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। অবহেলার মনোভাব দূর করতে হবে। বিশদভাবে সমাজ নিয়ে প্রতিটি মানুষকে কাজ করতে হবে। আগে সামাজিক যে অনুষ্ঠানগুলো হতো সেগুলো হচ্ছে না। বিভিন্ন ক্লাব যেরকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলার আয়োজন করত, সেভাবে আয়োজন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। সেগুলো আবার শুরু করতে হবে। তাহলেই সংস্কৃতিচর্চা আবার নিজের জায়গা ফিরে পাবে।
কথাকলি, সিলেটের কর্মী নীলাঞ্জন দাশ টুকু নিজের অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, সংস্কৃতিবান্ধব সরকার বললেও আসলে কতটা সংস্কৃতিবান্ধব সেটা আমি বুঝি না। কেননা আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা তো সরকারের কাছে টাকা চাইছি না। আমরা আমাদের নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে রিহার্সেল করছি, নাটকের আয়োজন করছি। কিন্তু সরকার আমাদের কী ধরনের সহযোগিতা করছে সেটা আমার বোধগম্য নয়। সিলেটে একটামাত্র অডিটোরিয়াম (কবি নজরুল অডিটোরিয়াম)। কয়েক বছর ধরে বলার পরেও এর সংস্কারের দিকে তেমন কোনো মনোযোগ দিতে দেখলাম না।
বর্তমানে সিলেটে সংস্কৃতিচর্চা কমে যাওয়ার জন্য নিজেদের দায়ী করে এই নাট্যকর্মী বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমরা আমাদের সন্তানদের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখছি। অন্যদিকে আমাদের সন্তানদের মায়েরাও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সেই সাথে আমরা বাবারাও এই মোবাইলের আসক্তিতে ডুবে গেছি। তাহলে সংস্কৃতিচর্চার সময় কোথায়? সবাই তো আকাশ সংস্কৃতিতে মজে গেছি। আমরা তো নিজেরাই নিজেদেরকে সময় দিচ্ছি না। সন্তানদের সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ করে দেবো কিভাবে? বর্তমান অবস্থার জন্য আমরা নিজেরাই আসলে দায়ী।
তিনি বলেন, এখনকার প্রজন্ম সংস্কৃতিচর্চাটাকে ইউটিউব আর ফেসবুককেন্দ্রিক করে ফেলেছে। তারা মনে করে যদি সেলিব্রিটি হওয়া যায়, স্টার হওয়া যায়, তাহলেই হলো। আর তা না হলে শেষ। এই মনোভাবের কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সংস্কৃতিচর্চার বিষয়টি একেবারে নেই বললেই চলে। আগ্রহটি একেবারে শূন্যের কোটায়। এই ব্যর্থতা কিন্তু আমাদের। কারণ আমরা অভিভাবকরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারছি না।
সিনিয়র এই নাট্যকর্মী বলেন, প্রতিটি সংস্কৃতিকর্মীর মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা থাকতে হয়। বয়োজ্যেষ্ঠরা এটাই বলে গেছেন। কিন্তু এখন দেখা যায় একজন সংস্কৃতিকর্মী নিজের সত্ত্বা ভুলে অন্য সত্ত্বায় নিজেকে লালন করতে বেশি পছন্দ করে। দেখা যায়, একজন সংস্কৃতিকর্মী বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে এমন করে জড়িয়ে ফেলেছে যে সংস্কৃতি অঙ্গনের চাইতে রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতি মনোযোগ বেশি। এতে করে সংস্কৃতি অঙ্গন অবহেলিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে গিয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনে বাধার দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
নিজেদের ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, এখন কোনো একটা নাটক করতে গেলে ১০ জনকে একত্র করাটা সম্ভব হয় না। গত ৩ বছর ধরে ৯৯ শতাংশ কর্মী অনুপস্থিত থাকছেন। এটাও আমাদের ব্যর্থতা। আর তরুণরা ইউটিউব, ফেসবুক সংস্কৃতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এসবে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
তিনি বলেন, সবারই এটা মাথায় রাখা উচিত যে এই দেশে প্রধান প্রধান আন্দোলনে সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের অনেক ভূমিকা রয়েছে। সেজন্য সংস্কৃতি না বাঁচলে দেশ কিন্তু বাঁচবে না। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে প্রথমে নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে। অনলাইনকেন্দ্রিক ঝোঁক থেকে সরে আসতে হবে। সংস্কৃতিচর্চা করতে হবে।
সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত বলেন, প্রতি বছর জুন, জুলাই এবং আগস্ট মাসে অনুষ্ঠানের আয়োজন কম থাকে। কেননা এই সময়টায় বর্ষার একটা প্রভাব থাকে। গতবছর বেশ কিছু অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলেও এ বছর বন্যার কারণে অনুষ্ঠান আয়োজন থেকে আমরা সরে এসেছি। আমরা সংস্কৃতিকর্মীরাও তখন বন্যার্তদের ত্রাণ সহযোগিতা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তবে আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকে আবার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। আমরা সেভাবে পরিকল্পনা করে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।
তিনিবলেন, করোনাকালে সবকিছু বন্ধ থাকার কারণে প্রত্যেক সংগঠনেই একটা মন্দাভাব কাজ করেছে। কিছু কিছু সংগঠনের কর্মী কমেছে। দীর্ঘ সময়ের একটা গ্যাপ তৈরি হওয়ার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই গ্যাপটা ফিলাপ করা সম্ভব।
জানা গেছে, সিলেটে সাংস্কৃতিক ও নাট্য সংগঠন মিলিয়ে শতাধিক সংগঠন আছে। যার মধ্যে নাটকের দল ২১টার মধ্যে ৭৫ শতাংশ সক্রিয় আছে। আর সাংস্কৃতিক সংগঠনের মধ্যে প্রায় ৬০-৭০টি সক্রিয়।
এ বিষয়ে কণ্ঠশিল্পী বিথী চৌধুরী বলেন, প্রথমে করোনাকাল, তারপর বন্যার কারণে আগের তুলনায় অনুষ্ঠান অনেক কমে গেছে বলবো। শতকরার দিক দিয়ে বললে বলবো অনুষ্ঠান ৭০ শতাংশ কমে গেছে। করোনার প্রকোপ কমার পর যা কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছিল, বন্যার কারণে তাও পুরোটাই বন্ধ হয়ে যায়।
সিলেটে অনুষ্ঠান কমে যাওয়ায় সিলেটের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে হচ্ছে বলে জানান এই শিল্পী। তিনি বলেন, গত ২/৩ মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ মিলিয়ে ৭/৮টি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। অথচ আগে অন্যান্য বিভাগের তুলনায় সিলেটেই বেশি অনুষ্ঠান হতো। যেসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো সেগুলো এখন একেবারেই হচ্ছে না। তবে সংগঠনগুলো সাহায্য নিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এটিও একটি ভালো কাজ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাউল গানের শিল্পী সৈয়দ আশিকুর রহমান আশিক বলেন, সাধারণত পুরো বাংলাদেশের মধ্যে সিলেটে বেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। আর আমি বলবো সংগঠনগুলো যদি আয়োজন না করে তাতে তো আপনার-আমার করার কিছু নেই। তবে বাণিজ্যিক অনুষ্ঠান কিন্তু হচ্ছে। আমরা সেটা কন্টিনিউ করছি।
চ্যানেল আই আয়োজিত ডি-রকস্টার ২০০৬ এর রানার্সআপ জাহিদ মাসুদ বলেন, আমরা আগে এরকম সময় মাসে ৮/১০টা অনুষ্ঠান করতাম। এখন সেখানে প্রোগ্রাম নেই বললেই চলে। শুধু করোনা কিংবা বন্যা পরিস্থিতি নয়, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণেই সংস্কৃতি অঙ্গনে এই অবস্থা চলে এসেছে। আগে সিলেটের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে প্রায় কনসার্টের আয়োজন করা হতো। নজরুল অডিটোরিয়ামে কনসার্ট হতো। যেটা বর্তমানে হচ্ছে না। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা সবকিছু মিলিয়ে মানুষের মন-মানসিকতা কেমন যেন হয়ে গেছে। হয়তে একটা সময় আবার হবে।
সিলেট ডিভিশনাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স দে বলেন, ‘শুধু সিলেট নয়। সারাদেশেই বর্তমানে কনসার্টের আয়োজনটা কমে গেছে। এর জন্য অর্থনৈতিক বিষয়টিকে আমি বেশি গুরুত্ব দেবো। দেখা গেছে আগে যারা কনসার্টের আয়োজন করতো বা যারা স্পন্সর করতো তারা হয়তো এখন আয়োজনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। হতে পারে তাদের অবস্থাটাও এখন ভালো না। আমি বলবো আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থাটা বর্তমানে খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। সেজন্য আমরা কনসার্টসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন থেকে সরে এসেছি। আমার বিশ্বাস শিগগির আমরা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবো।’