বহুল আলোচিত বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কার্যত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ৯ ডিসেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জোটের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে শরিকদের এমন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানাবে না। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা না বলতে শরিকদেরও অনুরোধ জানিয়েছে দলটি।
ওই বৈঠকে শরিকদের ‘জোট’ গঠন করে কিংবা ‘একক’-যেভাবেই হোক যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জোটে থাকা ১১ রাজনৈতিক দল নতুন করে একটি ‘ফ্রন্ট’ গঠন করছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘জাতীয়তাবাদী ঐক্যজোট’ নামে এই ফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ হতে যাচ্ছে। এছাড়া ৬টি দলও আলাদা জোট গঠনের চেষ্টা করছে। তবে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি এককভাবে কর্মসূচি পালন করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘২০ দল জোট হিসাবে নেই। বিএনপি ইতোমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আশা করছি জোটে থাকা শরিকরা যুগপৎ আন্দোলনে থাকবেন।’
২০ দলীয় জোটে থাকা অন্তত ১৪টি শরিক দলের শীর্ষ নেতারাও জোট ভেঙে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তারা জানান, ৯ ডিসেম্বরের বৈঠকে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ২০ দলীয় জোটের অস্তিত্ব নেই। তাই এই জোটকে ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। বিএনপি নেতারা শরিকদের কাছে বিষয়টি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কৌশলগত কারণে ভেঙে দেওয়া হলো জানিয়ে জোটের শরিকদের উদ্দেশ করে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ‘আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জোটকে ভাঙছি তা প্রচার করব না। কিন্তু আমরা যুগপৎ করছি। আপনারা যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলন করবেন। যদি মনে করেন যে, আপনাদের নিজেদের মধ্যেও সখ্য বা একটা বোঝাপড়া আছে, তারা মিলে কিছু করবেন সেটাও করতে পারবেন। যে যেভাবে পারেন বিএনপি ঘোষিত ১০ দফা দাবি সমর্থন করে যুগপৎ আন্দোলনে থাকবেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, কৌশলগত কারণে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যা শরিকদের অবহিত করা হয়। তবে তারা যে যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকবে। মূলত সাংগঠনিক শক্তির দিক থেকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপির অবস্থান রয়েছে। এজন্য অন্য শরিকদের বলা হয়েছে তারাও যুগপৎ আন্দোলনে যেন অংশ নেয়। সেক্ষেত্রে কয়েকটি দল মিলেও পৃথকভাবে মোর্চা গঠন করে এক সঙ্গে মাঠে থাকতে পারেন। সে পথেই যাচ্ছে। এতে করে সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে সব দলকেই পাশে পাওয়া যাবে।
সূত্রমতে, মূলত ডান-বাম ও ইসলামী দলগুলোকে এক কাতারে এনে যুগপৎ আন্দোলন চায় বিএনপি। এক্ষেত্রে ২০ দলীয় জোট হিসেবে সামনের যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিলে জামায়াত বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্তরায় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। তাই ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা শরিকদের জানিয়েছে বিএনপি।
এখন জামায়াত বাইরে থেকে যুগপৎ আন্দোলনে থাকলেও তাতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দল কোনো অন্তরায় মনে করছেন না বলে জানান বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক। তারা বলেন, তাদের মূল লক্ষ্য প্রথমত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবি আদায়, দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকারের পতন; এবং তৃতীয়ত, সুষ্ঠু নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এলে রাজপথে থাকা সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন।
প্রসঙ্গত, চারদলীয় জোটের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১৮ দল এবং পরে পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি দল নিয়ে ২০ দলীয় জোট গঠিত হয়। ডানপন্থি ও মধ্য-ডানপন্থি দলগুলোর সমন্বয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী এ জোট গড়ে উঠেছিল।
সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটে থাকা ১১ রাজনৈতিক দল এখন একটি ফ্রন্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে দলগুলোর শীর্ষ নেতারা কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। প্রাথমিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ঐক্যজোট’ ও ‘সমমনা ১১ দল’- এ দুটি নাম ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয়তাবাদী ঐক্যজোট নাম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ জোট যৌথ নেতৃত্বে চলবে এবং একজন সমন্বয়ক থাকবেন। ১১ দল হলো-মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর), মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় দল, এম আবু তাহেরের নেতৃত্বে এনডিপি, শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ এলডিপি, অ্যাডভোকেট জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, মুফতি মহিউদ্দিন ইকরামের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাওলানা আবদুর রকীবের নেতৃত্বে ইসলামী ঐক্যজোট, কমরেড নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল ও অ্যাডভোকেট আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনে আমাদের সবার অবদান থাকবে। কিন্তু সেটাকে আরও সুসঙ্গতভাবে করার জন্য একতাবদ্ধ হতে চাচ্ছি। মৌলিক লক্ষ্য হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলন, সরকার পতনের আন্দোলন।’
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘বিশদলীয় জোটভুক্ত ১১টি সমমনা দল যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই সরকার পতনে যুগপৎ আন্দোলন করব। বিএনপি ঘোষিত সব কর্মসূচিতে আমাদের সহমত ও সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকবে। বৃহস্পতিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জোটের আত্মপ্রকাশ হবে। ৩০ ডিসেম্বর ১১ দলের পক্ষ থেকে বিজয়নগর থেকে গণমিছিল বের করব।’
জোট ভেঙে গেলেও আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি দাবি করে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। আমরা আগে যেভাবে রাজপথে ছিলাম এখনো সেভাবে সক্রিয় থাকব। তবে এবার আমরা ১১ দল আলাদা রাজনৈতিক মোর্চা করে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেব।’
সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোটে থাকা আরও ৬টি দলও একটি ‘ফ্রন্ট’ গঠনের চেষ্টা করছে। দলগুলো হলো-ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাপ ভাসানী, ডেমোক্রেটিক লীগ, পিপলস লীগ ও বাংলাদেশ ন্যাপ।
এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘আমরা যুগপৎ আন্দোলনে রাজপথে থাকব। যেহেতু ২০ দলীয় জোট নেই, সেজন্য একটা সমমনা জোট করব। শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে জোটের ঘোষণা করা হবে। সেখানে ৯ থেকে ১০টি দল থাকবে।’
এদিকে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এককভাবে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে। ঢাকার বাইরে সারা দেশের মহানগর ও জেলায় ২৪ ডিসেম্বর গণমিছিল করবে। আর ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় হবে গণমিছিল। এককভাবে একই কর্মসূচি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীও।
দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘আমরা যেহেতু যুগপৎ আন্দোলনে আছি, কর্মসূচিও একই হবে। একইদিনে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নিজ নিজ ব্যানারে গণমিছিল করবে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো। কেউ কারও কর্মসূচিতে অংশ নেবে না।’
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বলেন, ‘আমরা এককভাবে কর্মসূচি পালন করতে সক্ষম। অক্টোবর ও নভেম্বরে আমরা দুটি সমাবেশ করে তা প্রমাণ করেছি। বিগত ’১৪ ও ’১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই দেশের জনগণ হতাশায় ভুগছে। একদলীয় শাসনের আওতায় আমরা চলছি। আমাদের মূল লক্ষ্য জনগণকে তাদের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সে লক্ষ্যে কর্মসূচিগুলো পালন করছি।’
সূত্র : যুগান্তর