সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে দেশের চলমান সামগ্রিক অবস্থার উপর বিবেচনা করে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ১৮ দফা প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে।
আজ রোববার (১১আগস্ট) দুপুরে ‘সিলেট ভয়েসকে’ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাবিপ্রবির নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজের সংগঠক অধ্যাপক ড. সাজেদুল করিম।
এসময় শাবিপ্রবির এই শিক্ষক জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের তথা দেশবাসীর অনেক প্রত্যাশা। সেই জায়গা থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দেশের চলমান সামগ্রিক অবস্থার উপর বিবেচনা করে আমরা ১৮ দফা প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা পেশ করেছি। আশা করি ড. মুহাম্মদ ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের এই ১৮ দফা গুরুত্বসহকারে দেখবেন।
শাবিপ্রবির নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে দেওয়া ১৮ দফাগুলো হচ্ছে,
১. দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিতে হবে। কেননা বিগত স্বৈরাচার সরকারের আমলে শুধুমাত্র দলীয় মতাদর্শী খুনিরা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে হেলমেটধারী সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে পুলিশ বাহিনীর যোগসাজশে নির্বিচারে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করে গণহত্যা চালিয়েছে এবং যা এখনো চলমান। অতিদ্রুত ওই সব অস্ত্র জমা নেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় সব অবৈধ অস্ত্র এবং দেশের বিভিন্ন থানা থেকে লুট করা অস্ত্র পরিপত্র জারি করে সংগ্রহের জোর দাবি জানাচ্ছি।
২. দলীয় লেজুড়ভিত্তিক প্রশাসন নির্মূল করতে সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিচার করতে হবে (বিশেষ করে প্রশাসন ও পুলিশ)। অনতিবিলম্বেমাঠ পর্যায়ে অস্থিরতা সৃষ্টি, নির্বিচারে গুলি, গণহত্যা ও লুটতরাজের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
৩. দেশের সব ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ করা বিচারপতিদের অতিদ্রুত অপসারণ করতে হবে।
৪. বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে পুলিশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে এনে জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ প্রশাসনকে পরিচালনা করা যেতে পারে।
৫. দেশের বর্তমানে চালু করা শিক্ষানীতি ও কারিকুলাম (বিশেষ করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে) অতি শীঘ্রই বাতিল করে বিশ্ববরেণ্য শিক্ষাবিদদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত চলমান কারিকুলাম স্থগিত করে আগের কারিকুলাম অনুযায়ী ২০২৪ সালের শিক্ষা
কার্যক্রম চালাতে হবে।
৬. শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে অধিকতর বরাদ্দের জন্য নূন্যতম ৬ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
৭. সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের হল/ছাত্রাবাসে শুধুমাত্র বৈধ ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাখাতে বরাদ্দের একটি অংশ ক্লাস রুম, গবেষণা এবং শিক্ষার্থীদের খাবারের মান উন্নয়নে ব্যবহার করতে হবে।
৮. পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক পদে একাডেমিক, যোগ্য, সৎ-সাহসী ও অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদদের নিয়োগ দিতে হবে।
৯. বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে।
১০. শিক্ষা, চিকিৎসা ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবের পদসমূহে স্ব-স্ব বিষয়ে দক্ষ এবং স্ব-স্ব বিভাগ থেকে ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
১১. বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এ কমিশনের অধীনে শিক্ষার সিলেবাস ও পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে। এ কমিশনের চেয়ারম্যান ও মেম্বারকে অবশ্যই শিক্ষাবিদদের মধ্যে থেকে নিয়োগ দিতে হবে।
১২. চলমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে চলমান সব উন্নয়ন প্রকল্প পুনর্মূল্যয়ন করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দুর্নীতি বন্ধের কার্যকর উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
১৩. ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ বিভাগের ডাকাতি বন্ধসহ সব দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
১৪. বিদেশে বাংলাদের ভাবমূর্তি সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য কর্মকর্তাগণকে নিরপেক্ষ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জরুরিভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
১৫. সরকারি, স্বায়ত্ত শাসিত, আধা-স্বায়ত্ত শাসিত ও বেসরকারি সব ধরনের প্রশাসনের গ্রোথিত দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে যারা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
১৬. নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। ভুয়া ভোটার চিহ্নিত করে তার তালিকা প্রকাশ এবং নতুন করে ভোটার তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে অতিদ্রুত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৭. দেশের এই ক্রান্তিকালে সংখ্যালঘুও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয় রক্ষার্থে বিশেষ টিম গঠন করার মাধ্যমে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসীরা এগুলো ধ্বংস করার মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্য সব ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সহাবস্থান কোনো ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
১৮. শিক্ষা কমিশন গঠন করে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে যুগোপযোগী করার প্রক্রিয়া অবিলম্বে শুরু করতে হবে। শিক্ষা ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সংস্কার অতিব জরুরি মনে করছি এবং সেক্ষেত্রে আমাদের কোনো অবদান রাখার সুযোগ দেয়া হলে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে অংশগ্রহণ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
এসময়, বিগত ১৫ বছর যাবত জনসাধারণের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে ২০২৪ এর সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত ও শহীদদের শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন শাবির এই শিক্ষক।