দিন দিন মামলাজট বাড়ছেই। নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে মিলিয়ে বিচারাধীন মামলা রয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ। এসবের মধ্যে সারা দেশের নিম্ন আদালতগুলোতেই অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা ৩৭ লাখের বেশি।
২০০৮ সালে দেশের অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল প্রায় ১৫ লাখ। মামলাজট ছাড়াতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে জোর দেওয়া, আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ, বিচারকদের সংখ্যা ও দক্ষতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন আইনজ্ঞরা। একই সঙ্গে আদালতে না গিয়ে সমাধান করা যায়, সেসব বিষয় দুই পক্ষ বসে সমাধান করলেও মামলা কমবে বলে মত তাঁদের।
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান গত মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ অসহনীয় মামলাজটে ন্যুব্জ। বিপুলসংখ্যক মামলার বিপরীতে বিচারকের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারপ্রার্থীরা প্রতিনিয়ত শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করা।
সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মামলার নিষ্পত্তি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। আগে দেশের আট বিভাগের বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতেন ৮ বিচারপতি, এখন ১৩ বিচারপতিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতি, সিনিয়র আইনজীবী, অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস, ঢাকার আদালতের বিচারকদের নিয়ে পৃথক বৈঠক করেছেন। সবার লিখিত মতামত নিচ্ছেন। সব বিষয় একত্র করে দ্রুতই হয়তো বিচার বিভাগের জন্য যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আদালত সূত্র জানায়, সারা দেশের আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে মোট ৪২ লাখ ৭৭ হাজার ৫০৪টি মামলা। এগুলোর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ২৬ হাজার ৫১৭টি এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪৭টি। আপিল বিভাগে থাকা মামলাগুলোর মধ্যে দেওয়ানি ১৬ হাজার ৬৭, ফৌজদারি ১০ হাজার ২৭০ এবং আদালত অবমাননা-সংক্রান্ত ১৮০টি। হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার মধ্যে দেওয়ানি ৯৫ হাজার ৫৩টি, ফৌজদারি ৩ লাখ ২২ হাজার ৫৬৪ এবং রিট ১ লাখ ৬ হাজার।
২০২৩ সাল পর্যন্ত অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারাধীন ছিল ৩৭ লাখ ৭ হাজার মামলা। এগুলোর মধ্যে দেওয়ানি ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ৪৪৪টি এবং ফৌজদারি ২১ লাখ ১০ হাজার ৬৯৬টি। এগুলোর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় বিচারাধীন দেওয়ানি মামলা ৪ লাখ ১১ হাজার ৬২৫টি এবং ফৌজদারি মামলা ৩ লাখ ৬২৯টি।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, দেশে মামলাজটের মূল কারণ হচ্ছে মিথ্যা মামলা দায়ের। বর্তমানে বিচারাধীন মামলার উল্লেখযোগ্যসংখ্যকই ফৌজদারি মামলা। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে দেওয়ানি মামলার জট কমতে পারে। থানার ওসি যে জামিন দিতে পারেন—সিআরপিসির এই বিধান পুলিশ কর্মকর্তারাও মনে হয় ভুলে গেছেন। সে জন্য ছোটখাটো অপরাধের জন্যও আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। গ্রাম আদালতের মাধ্যমেও অনেক মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য মোহাম্মদ সাঈদ আহমেদ (রাজা) বলেন, নিজেদের বিরোধ নিজেরা না মিটিয়ে কিছু হলেই আদালতে যাওয়ার প্রবণতা মামলাজটের মূল কারণ। বিচারব্যবস্থার বর্তমান অবস্থায় কখনোই মামলাজট শেষ হবে না। এখন অনেক ধাপ পার হয়ে মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়। এ জন্য বিচারব্যবস্থা পুরোপুরি ডিজিটালাইজড করতে হবে। আইনজীবীদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।