দেশমাতৃকার সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন সিলেটের বুদ্ধিজীবীরা

১৯৭১ সালে দেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হওয়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে পাক হানাদারদের দোসর আলবদর, রাজাকারদের সহায়তায় বুদ্ধিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে গণহত্যার শিকার হতে হয়েছিল। সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয় ১৪ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার বুকে। নৃশংসতার এমন নজির আর কোথাও নেই। নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয়েছিল সিলেটের বুদ্ধিজীবিদেরও।

শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস। যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের লক্ষ্যে সিলেটে সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে শনিবার সকালে শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে।

সিলেটের বুদ্ধিজীবীরা

সিলেট অঞ্চলের অধিবাসী অনেক বুদ্ধিজীবীও দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে আত্মাহুতি দেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ডা. শামসুদ্দিন আহমদ। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ডা. শামসুদ্দিন আহমদ সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ই তিনি রাজনৈতিক নেতাদের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আহতদের শুশ্রূষার জন্যে শহরতলিতে খোলা হবে পাঁচটি চিকিৎসা কেন্দ্র। তাঁর এই উদ্যোগ সফল না হলেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁকে গুলিবিদ্ধ আর বোমার আঘাত প্রাপ্তদের সেবা করতে দেখা গেছে।

পাক সেনারা ৯ এপ্রিল সিলেট শহর পুনঃদখল করে নিলে সেদিন প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় মুক্তিবাহিনী ও পশ্চিমা দস্যুদের মধ্যে। আহত হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষও। সামরিক কর্তৃপক্ষ ডা. শামসুদ্দীন আহমদকে নির্দেশ দেন, সেনা ছাউনিতে গিয়ে জখমপ্রাপ্ত সেনাদের চিকিৎসা করতে; কিন্তু তিনি তা উপেক্ষা করে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই আহত লোকজনের সেবা করতে থাকেন। এতে তাঁর উপর ক্ষেপে যায় জল্লাদরা। তাই তাঁকে ঐ দিনই সহযোগী ডা. শ্যামল চন্দ্র লালা, সেবক মাহমুদুর রহমান ও অ্যাম্বুলেন্স চালক কোরবান আলী ও আরো কয়েকজনসহ হত্যা করে।

বিয়ানীবাজার উপজেলার মাথিউরা গ্রামের কমর উদ্দিন ছিলেন বাউল শিল্পী এবং লন্ডন প্রবাসী; কিন্তু দেশের প্রতি টান ছিল বলে শত ব্যস্ততার মাঝেও সবসময় দেশে কখন কি ঘটছে সে খবর রাখতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিন আগেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। অগ্নিঝরা গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করতে থাকেন মানুষকে। তাঁর এই দেশাত্ববোধ এবং কর্মচাঞ্চল্যকে দালালরা মেনে নিতে পারেনি। এ কারণেই ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের দিয়ে তাঁকে হত্যা করায়।

আরেক বীর সেনানী মাওলানা অলিউর রহমান পেশায় ছিলেন হোমিও চিকিৎসক। তার মূল বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার মইয়ারচর গ্রামের হলেও তিনি থাকতেন ঢাকায়। একাত্তরের ১২ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার সেনারা লালবাগ মসজিদ থেকে স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে ১৪ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে হত্যা করে। প্রখ্যাত আলেম অলিউর রহমান রাজনীতি করতেন। প্রথমদিকে জড়িত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সাথে; কিন্তু এক পর্যায়ে এই ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে গড়ে তুলেন আওয়ামী ওলামা পার্টি। প্রকাশ্যে সমর্থন জানান ঐতিহাসিক ছয় দফার প্রতি। এছাড়া ‘ইসলামের দৃষ্টিতে ছয়দফা’, ‘যুক্তি ও কষ্টি পাথরে ছয়দফা’, ‘জয়বাংলা ও কয়েকটি স্লোগান’ প্রভৃতি বইও লিখেন। স্বতন্ত্র ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জন্যে মাওলানা অলিউর রহমানই প্রথম দাবি তুলেছিলেন।

অ্যাডভোকেট রামরঞ্জন ভট্টাচার্য ছিলেন একজন আইনজীবী এবং সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি)। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে তিনি স্ত্রী সহ সিলেট শহরের চালিবন্দরের বাসা ছেড়ে চলে যান বালাগঞ্জ উপজেলার বুরুঙ্গা এলাকায় তাঁর এক পরিচিতজনের বাড়িতে। তবে সেখানেও তাঁকে নিরাপত্তার প্রয়োজনে একাধিকবার অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়।

একাত্তরের ২৬ মে পশ্চিমা জল্লাদরা বুরুঙ্গায় গণহত্যা চালায়। হত্যা করে ৭৮ জন স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে। এর মধ্যে অ্যাডভোকেট রামরঞ্জন ভট্টাচার্যও একজন। অন্য সবাইকে এক সাথে মারা হলেও এই নিঃসন্তান দেশপ্রেমিক আইনজীবীকে আলাদাভাবে চেয়ারে বসিয়ে প্রাণ সংহার করা হয়।

বিয়ানীবাজার উপজেলার কসবা গ্রামের আব্দুল মান্নান ছিলেন একজন ক্রীড়া সংগঠক ও ফুটবল রেফারি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই তিনি হয়ে উঠেন অন্য মানুষ। ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রিয় জন্মভূমির মুক্তির লড়াইয়ে। এ ‘অপরাধে’ পশ্চিমা জল্লাদরা তাঁকে ধরতে হানা দেয় বাড়িতে; কিন্তু না পেয়ে তার স্ত্রী-সন্তানদেরকে ধরে নিয়ে যায়।

আব্দুল মান্নান স্ত্রী-সন্তানদেরকে মুক্ত করতে শেষ পর্যন্ত ধরা দিতে বাধ্য হন। হানাদাররা ৮ জুন হত্যা করে তাঁকে। এর আগে তিনি তাঁর এক ভাইকে পাকিস্তানি পশুদের উপর প্রতিশোধ নেয়ার নির্দেশ দিয়ে একটি চিঠি লিখে যান।

এছাড়া অ্যাডভোকেট এমএ হাফিজ, ডা. আব্দুন নূর, ঢাকায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন দার্শনিক ড. জিসি দেব, ড. এমএ মুক্তাদির, অধ্যাপক অনুপ দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য ও প্রকৌশলী মোজাম্মেল আলী এবং চট্টগ্রামে বাঙালি সেনা কমকর্তা কর্নেল এম আর চৌধুরী ও উচ্চপদস্থ রেল কর্মকর্তা শফি আহমদকে পশ্চিমা হায়নার দল এবং ঘাতক রাজাকার-আল বদর-আল শামসরা হত্যা করে।

যেখানে শায়িত আছেন সিলেটের বুদ্ধিজীবীরা

সিলেট নগরের কেন্দ্রস্থলের জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা সড়কের পাশে ৩৩ শতক জায়গাজুড়ে আছে শহীদ মিনার ও শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান। ভাষাশহীদ মিনারের আদলে নির্মিত শহীদ মিনারটি ছিল ৮ শতক জায়গায়। তার এক পাশে রয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধযুদ্ধের সময় সদর হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে কর্তব্যরত অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত চিকিৎসক শামসুদ্দিন আহমদসহ তাঁর সহকর্মীদের কবরস্থান।

শহীদ মিনার ও কবরস্থান আলাদাভাবে ছিল। ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে একটি মিছিল থেকে ভাঙচুর হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এরপর নতুন রূপে এটি পুণঃর্নির্মাণ করা হয়।

তখন শহীদ মিনারের নকশা করেছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক শুভজিৎ চৌধুরী। বুদ্ধিজীবী কবরস্থানকে একীভূত করে শহীদ মিনারের বর্তমান পুনর্বিন্যাসের নকশাও করেছেন শুভজিৎ চৌধুরী।

সিলেটের বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দেয়া বীর শহীদদের স্মরণ করতে প্রতিদিন সকল বয়সী মানুষ এখানে এসে পরম শ্রদ্ধায় অবনত হোন। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে নতুন প্রজন্মের কাছে গণহত্যার ছবি ম্লান হয়ে গেছে। অনেকেই জানেন না কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে। এমনকি যাঁরা জানেন তারাও যুদ্ধের ও গণহত্যার রক্ত সাগর পেরিয়ে এসে এখনো উপলব্ধির সময় পেলেন না কেন বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরে।

এখনো রক্তাক্ত ক্ষতের মতো জাগ্রত ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর। চিহ্নিত-অচিহ্নিত বধ্যভূমির মাটিতে, ভুলে যাওয়া বন্দিশালার দেওয়ালে, স্বজনহারাদের স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো একাত্তরের সকল মৃত্যু দুঃখের প্রদীপ হয়ে জ্বলে। সেই অজস্র ব্যথার পূজা এখনো যে হয়নি সমাপন।

এই দিনে ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি তার প্রিয় বুদ্ধিজীবীদের হারিয়ে শোকে ম্যুহমান হয়ে পড়ে। প্রতি বছর গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সারাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সাথে এ দিন সিলেটবাসীও স্মরণ করেন সুরমাপাড়ের সূর্য সন্তানদের।