প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই শনিবার সকালে খুলেছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দুয়ার। এর একদিন পর আজ রোববার ভোর ৬টায় শুরু হচ্ছে সেতু দিয়ে যান চলাচল। নির্ধারিত টোল দিয়ে থ্রি-হইলার ছাড়া যেকোনো গাড়ি পার হতে পারবে সেতু।
পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকায় যান চলাচল শুরুর দিনে ব্যাপক ভিড় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও যথাযথ প্রস্তুতি রেখেছে বলে জানানো হয়েছে।
ভায়াডাক্টসহ ৯ দশমিক ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতুটির টোল আদায় কার্যক্রম দ্রুতগতির করতে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের দুটি টোলপ্লাজায় বসানো হয়েছে সাতটি করে মোট ১৪টি গেট। যান চলাচলে সেতুটি খুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই প্রান্তের ১৪টি টোল গেট চালু হয়ে যাবে। সবকটি গেটে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ভাড়া আদায় করা হবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী (কারিগরি) কাজী মোহাম্মাদ ফেরদৌস।
তবে সেতুর টোল আদায় প্রক্রিয়া মাত্র ৩ সেকেন্ডের মধ্যে নিয়ে আসতে চায় কর্তৃপক্ষ। সে জন্য টোলপ্লাজায় বসানো হচ্ছে আধুনিক ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন (ইটিসি) বুথ। এটি চালু হয়ে গেলে চলমান গাড়ি থেকে মাত্র ৩ সেকেন্ডে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল আদায় করা যাবে।
প্রথম পর্যায়ে সেতুর দুই প্রান্তের টোলপ্লাজায় দুটি গেটে বসানো হবে ইটিসি বুথ। পর্যায়ক্রমে দুই প্রান্তের অন্য ১২টি গেটেও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা হবে। তবে এ কাজটি সম্পন্ন করতে আরও ছয় মাস লাগবে বলেও জানিয়েছেন কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস।
পদ্মা সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশনকে। তারাই ইটিসি বুথগুলো স্থাপনে কাজ করছে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে টোল পরিশোধের জন্য যানবাহনের উইন্ডশিল্ডে লাগাতে হবে বিশেষ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) কার্ড। ফাস্ট ট্র্যাকের মাধ্যমে এই প্রি-পেইড কার্ড থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল কেটে নেবে ইটিসি বুথ।
ইটিসি বুথ স্থাপনের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি গেট থেকে ম্যানুয়ালি টোল আদায় করা হবে বলে জানান বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী।
সেতু সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতু এলাকায় একটি অটোমেটিক টোল সিস্টেম থাকবে। এটা এমন নয় যে ২৫ তারিখ থেকেই চালু হয়ে যাবে। এর জন্য আমাদের কিছুটা সময় লাগবে। যে কোম্পানি কাজ নিয়েছে তাদের অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে ইটিসি চালু করতে।’
কোরিয়া ও চীনের দুটি কোম্পানি যৌথভাবে পাঁচ বছরের জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতু রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ের দায়িত্ব পেয়েছে। এরা হলো কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি) এবং চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি)। কোম্পানি দুটি এ জন্য পাবে ৬৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
পদ্মা সেতুর টোল :
গত ১৭ মে পদ্মা সেতুর টোল হার প্রকাশ করে সরকার। সে হিসাবে এই সেতু পাড়ি দিতে মোটরসাইকেলকে দিতে হবে ১০০ টাকা।
প্রাইভেট কার ও সাধারণ জিপে টোল ঠিক করা হয়েছে ৭৫০ টাকা। পিকআপ ও বিলাসবহুল জিপ পারাপারে টোল ধরা হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা।
মাইক্রোবাস পারাপারে সেতুর টোল ১ হাজার ৩০০ টাকা। ৩১ বা এর কম আসনের ছোট বাসের জন্য দিতে হবে ১ হাজার ৪০০ টাকা। মাঝারি বাসের টোল ২ হাজার টাকা। বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা।
পাঁচ টনের ট্রাক এই সেতু পাড়ি দিলে গুনতে হবে ১ হাজার ৬০০ টাকা। পাঁচ টন থেকে আট টনের মাঝারি ট্রাকের জন্য দিতে হবে ২ হাজার ১০০ টাকা। আট টন থেকে ১১ টনের মাঝারি ট্রাকের টোল ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা।
থ্রি এক্সেলের ট্রাক পারাপারে টোল ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। মালবাহী ট্রেইলারের (চার এক্সেল) টোল ৬ হাজার টাকা। চার এক্সেলের ওপরে মালবাহী ট্রেইলারের জন্য প্রতি এক্সেলে দেড় হাজার টাকা যোগ হবে।
বর্তমানে ফেরিতে নদী পারাপারে যে হারে মাশুল দিতে হয়, সেতুতে তা দেড় গুণ বা আশপাশে বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে পদ্মা সেতুর জমকালো উদ্বোধন ঘিরে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত শিমুলিয়া-মাঝিরকান্দি নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
বিকেল পর্যন্ত মাওয়া প্রান্তে দূরপাল্লা বা দক্ষিণবঙ্গগামী কোনো যান বা যাত্রীবাহী বাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। তবে বিকেলের পর রাজধানী থেকে মাওয়া পর্যন্ত যাত্রীবাহী বাস চলাচল শুরু হয়েছে। ইলিশ পরিবহনের রবিউল ইসলাম জানান, ‘দুপুর পর্যন্ত প্রোগ্রাম থাকায় বাস চালানো হয়নি। তয় বিকেল থেকে খেপ মারা শুরু করছি।’
এসব গাড়িতে চড়ে অনেকেই এসেছেন সেতু দেখতে। অনেকে ভেবেছেন সেতুতে হাঁটাহাঁটির সুযোগ পাবেন। রাজধানী থেকে আসা পাভেল ইসলাম বলেন, ‘ভেবেছিলাম সেতুতে উঠতে পারব। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম সেই সুযোগ নেই।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে মাওয়া প্রান্ত ছাড়ার পর পরই উপস্থিত জনতা হুড়োহুড়ি করে সেতুতে উঠে পড়েন। কেউ কেউ সীমানা বেড়া ডিঙিয়ে, আবার কেউ সীমানা বেড়া ছিঁড়ে সেতুর ভায়াডাক্ট অংশে ঢুকে পড়েন। তারপর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেতুজুড়ে কড়া নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছেন।