আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক খুন, সংঘর্ষ আর অস্ত্রের মহড়া ছিল নিয়মিত ঘটনা। প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকত এখানকার বাসিন্দারা। বলছিলাম সিলেটের ‘কিলিং জোন’ খ্যাত টিলাগড়ের কথা৷
টিলাগড়। শান্ত সিলেট নগরীর আলোচিত-সমালোচিত একটি এলাকা। শতবর্ষী এমসি কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এ এলাকায় অবস্থিত। সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ ৪ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখানে থাকার কারণে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে টিলাগড়ের কদর বরাবরই ছিল আকাশচুম্বী। টিলাগড়ের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া থাকতেন সবাই। বিশেষ করে আ.লীগ সরকারের সাবেক এমপি এড.রনজিত সরকার এবং সিলেট সিটি করপোরেশনের ২০ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ এখানকার বাসিন্দা হওয়ায় তাদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শক্তিশালী দুটি গ্রুপ৷ এই দুই নেতার প্রত্যক্ষ মদদে এখানে রাজনৈতিক সংঘর্ষে রক্ত ঝরার ইতিহাস যেমন আছে, তেমনি আছে নিরীহ মানুষ খুনের ঘটনাও। পুরো সিলেট নগরীতে যে পরিমাণ অপরাধ সংঘটিত হতো তার চেয়ে বেশি হত এই টিলাগড়েই। একের পর এক হত্যা, সংঘর্ষ ও অস্ত্রের মহড়ার ঘটনায় ‘কিলিং জোন’-এ পরিণত হয়েছিল টিলাগড়। এছাড়াও ছাত্রদল- ছাত্রলীগ,কিংবা ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও টিলাগড়ের নিত্যনৈমত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রভাব বিস্তার, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা কারণে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে টিলাগড়ে। এসব অপকর্ম রোধে ছাত্র সংগঠনগুলোতে বহিষ্কার, কমিটি স্থগিতসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল টিলাগড় কেন্দ্রীক রাজনীতি। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টিলাগড়ে খুনের শিকার হয়েছেন- ছাত্রলীগ কর্মী তানিম খান, মেধাবী শিক্ষার্থী আকবর সুলতান, মিজান কামালী, উদয়েন্দু সিংহ পলাশ, জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম, ওমর আহমদ মিয়াদ ও ব্যবসায়ী করিম বক্স মামুন। মূলত,টিলাগড়ে খুনের রাজনীতির শুরু ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি প্রতিপক্ষের অতর্কিত হামলায় খুন হন আকবর সুলতান। আকবর সিলেট সরকারি কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন।
পুলিশ সূত্রে ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গেল এক দশকেই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে টিলাগড় এলাকায় কমপক্ষে ৩০টির বেশি সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতিটিতেই ছিল অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার।
একের পর এক খুন, সংঘর্ষে উদ্বিগ্ন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। এসব ঘটনায় মামলা হলেও কখনও কোন হত্যা কিংবা সংঘর্ষের বিচার হয়নি৷ যেকারণে দিনদিন অস্বস্থিকর হয়ে উঠেছিল টিলাগড়ের পরিবেশ। এর প্রভাব পড়তো এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাসা বাড়ি সহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও। সংঘর্ষের সময় হামলা ও ভাংচুরের ভয়ে টিলাগড়ের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হত। ফলে ক্ষতির মুখে পড়তেন ব্যবসায়ীরা। কখন কি হয় এই ভেবে স্থায়ীয়রা বরাবরই আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন। সন্তানদের বাসার বাইরে পাঠিয়ে চিন্তিত থাকবেন অভিভাবকরা। বিভিন্ন সময় সংঘর্ষের পর এখানে থাকা এমসি কলেজ, সরকারি কলেজ সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আবাসিক হলগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হত প্রশাসন। এর ফলে ভোগান্তিতে পড়ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বদলে যায় টিলাগড়ের পরিবেশও। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এখানকার বাসিন্দা, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সবাই।
মুস্তাক আহমেদ নামে টিলাগড়ের এক ব্যবসায়ী বলেন, কখন যে সংঘর্ষ বেঁধে যায় এই ভয়ে সারাক্ষণই একটা আতঙ্ক কাজ করত। এখন আর সেই ভয় কাজ করে না৷ আমরা নির্ভয়ে ব্যবসা করছি এতেই শান্তি।
টিলাগড়ের শাপলাবাগ এলাকার বাসিন্দা মিনতি রানী দাস বলেন, আমার দুইটা ছেলে এমসি কলেজে পড়ে। কিছুদিন আগেও ওরা যখন ক্যাম্পাসে যেতে বাসা থেকে বের হতো তখন থেকেই দুঃচিন্তায় থাকতাম। এখন সেই দুঃচিন্তা কাজ করে না৷ যারাই ক্ষমতায় থাকুক টিলাগড়ের পরিবেশ সবসময় এমনটাই থাকবে বলে প্রত্যাশা করেন এই অভিভাবক।
সিলেটের শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুনুর রশিদ চৌধুরী সোমবার (১১ নভেম্বর) সকালে ‘সিলেট ভয়েসকে’ বলেন রাজনৈতিক কারণে একটা সময় এই এলাকায় মাঝে-মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত, এখন সেটি নেই। টিলাগড় এখন শান্ত। সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকায় কোন ধরণের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য সারাক্ষণই পুলিশের টহল থাকে বলে জানান এই কর্মকর্তা।