সরকার হাওর রক্ষা বাঁধ রক্ষায় গুরুত্ব সহকারে দ্রুত কাজ সম্পাদনের লক্ষ্যে নতুন নীতিমালা গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গড়িমসি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের শাখা কর্মকর্তা (এসও) এটিএম মোনায়েম হোসেন টাকার বিনিময়ে পিআইসি গঠন এবং বাঁধ বাণিজ্যের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজের নির্ধারিত সময়সীমার দেড় মাস অতিবাহিত হলেও অনেক বাঁধে কাজই শুরু হয়নি। এমনকি উপজেলার বৃহৎ ৬টি হাওরের সবকটি ক্লোজার ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ফলে আগাম বন্যা থেকে বোরো ফসল রক্ষায় শংকা প্রকাশ করছেন হাওর পাড়ের কৃষকরা।
স্থানীয়রা জানান, এসও মোনায়েম হোসেন দীর্ঘদিন দিরাই থাকার সুবাধে গড়ে তুলেছেন পিআইসি ( প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) সিন্ডিকেট। কোনো নীতিমালার তোয়াক্কা না করে গঠন করা হয়েছে অধিকাংশ পিআইসি। স্থানীয় কৃষকরা এসব পিআইসি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একাধিক লিখিত অভিযোগ করলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। নানা অজুহাতে কৃষকদের অভিযোগ ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ বাণিজ্যেের কারণে ২০১৭ সালের আগাম বন্যায় দিরাইসহ সুনামগঞ্জের সবকটি হাওরের ফসল তলিয়ে যায়। এরপর সরকার নতুন নীতিমালা প্রনয়ন করে। ২০১৮ সাল থেকে ২২’সাল পর্যন্ত সরকার প্রায় শতকোটি টাকা বরাদ্দ দিলে হাওর রক্ষা বাঁধ দৃশ্যমান হয় এবং আগাম বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষা পায়।
কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাউবোর শাখা কর্মকর্তা তার খেয়াল খুশিমতো পিআইসি বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। উপজেলার ইউনিয়নে ইউনিয়নে রয়েছে তার সিন্ডিকেট। বরাম হাওরের প্রকল্প নং ৮২ ও ৮৩ এবং টাংনির হাওর প্রকল্পের ২৯ নং পিআইসি সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য সাজ্জাদুরের মাধ্যমে বিভিন্ন নামে পিআইসি গঠন করে নিয়ন্ত্রণ করছেন এসও। একজনকে এই তিনটি প্রকল্পের কাজ মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সাজ্জাদুরের সাথে আলাপকালে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়। তিনটি পিআইসিই মোটরসাইকেল চালকদের নামে দেওয়া হয়েছে।
অপর দিকে টাংনির হাওর প্রকল্পের ৩০ ও ৩২ এবং চাপতির হাওর প্রকল্পের ২ নং পিআইসি রামপুর গ্রামের এসও’র মনোনিত পিআইসি সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য নজরুল ইসলামের নিজস্ব লোকদের দেওয়া হয়। এছাড়া বিগত ২২-২৩ অর্থ বছরের পিআইসিদের কাছ থেকে বিল বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে বিশাল অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে এসও মোনায়েমের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসছে এসব রমরমা বানিজ্যের বিষয়টি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা যায়, গেল বছরে টাংনীর হাওর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের ৫৯, ৬০ ও ৬১ নং পিআইসির বিল বাড়িয়ে দিয়ে ৩ লক্ষের বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পাউবোর এই কর্মকর্তা। একইভাবে ৬০ ভাগ কাজ হলে বিল বৃদ্ধি করে ৯৩ ভাগ বিল উত্তোলন করে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে। বিল বাড়ানোর হিস্যার টাকা ব্যাংক থেকে আনতে রয়েছে তার নিজস্ব লোক। তুফানখালী বাঁধ প্রকল্পসহ উপজেলার বেশ কয়েকটি বাঁধে শেয়ার বানিজ্য রয়েছে এই পাউবো কর্মকর্তার।
এ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এরমধ্যে পিআইসি গঠন করা হয়েছে ১১০ টি প্রকল্পের। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ শুরু হয়নি টাংনীর হাওর প্রকল্পের ৩২ নং পিআইসিসহ অনেক প্রকল্পে। টাংনীর হাওর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের ৩০ নং পিআইসির সেক্রেটারি রঞ্জু দাসের সাথে কথা হলে তিনি তার পিআইসি নাম্বার, বরাদ্দ কিছুই বলতে পারেন নি। তিনি বলেন, আমার এসব জানা নাই, এসব নজরুল ইসলাম জানেন।
অভিযোগ রয়েছে এই পিআইসি বাঁধের নিকটবর্তী গ্রামের আবেদীত কৃষকদের না দিয়ে ১ কিলোমিটার দূরের গ্রামের লোকজন দিয়ে টাকার বিনিময়ে পিআইসি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে টাংনীর হাওরের কৃষক সামিনুর চৌধুরী জানান, এসও মোনায়েম ৫০ হাজার টাকায় ৩০ নং পিআইসি দেওয়ার আশ্বাস দেয় ,কিন্তু ১ম বিল পেয়ে টাকা দেব এ কথা বলায় আরও বেশি টাকা পেয়ে রামপুর গ্রামের ভুমিহীন একজনকে সদস্য সচিব করে তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে।
এককই রকমভাবে স্থানীয় প্রিয়তোষ দাসকে ২৯ নং পিআইসি প্রকল্প এলাকার সীমানা বুঝিয়ে দিয়ে সাইনবোর্ড টাংঙ্গানোর পরও কাজ দেওয়া হয়নি। এব্যাপারে প্রিয়তোষ জানান, আমাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সাইনবোর্ড পর্যন্ত টাঙ্গানো হয়। কিন্তু বাধেঁর পাশ্ববর্তী বাড়ি থাকা সত্ত্বেও এসও স্যারের চাহিদা মত টাকা না দিতে পারায় আমাকে কাজ দেওয়া হয়নি। আমি মাটি জমি কিনে ক্ষতিগ্রস্ত্র হয়েছি। জালালপুর গ্রামের লোকজন দিয়ে পিআইসি দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে ২৯ নং পিআইসি সভাপতি পুরঞ্জন পালের আলাপ হলে তিনি বলেন, প্রিয়তোষকে কাজ দেওয়া হয়েছিল ঠিক কিন্তু সাজ্জাদুর ভাই এসও স্যারকে ম্যানেজ করে আমাকে কাজ দিয়েছেন।
পিআইসি গঠনে সীমাহীন অনিয়মের অভিযোগ এনে রফিনগর ইউনিয়নসহ অন্যান্য ইউনিয়নেও কৃৃষকরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একাধিক অভিযোগ করেছেন। এছাড়া বরাদ্দের অর্থ ভাগবাটোয়ারা করার লক্ষ্যে অক্ষত বাঁধেও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে এবং বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এসব অনিয়ম সম্পর্কে জানতে উপজেলা কাবিটা স্কীম বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং কমিটির সভাপতি ও নবাগত উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহমুদুর রহমান খোন্দকারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যোগদান করেই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়েছে। পিআইসি গঠন নিয়ে অনেক ইনফরমেশন পাচ্ছি, যাচাই বাঁছাই করে দেখছি।
তিনি বলেন, হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নিয়ে কোন গাফিলতি সহ্য হবে না।