সিলেট দক্ষিণ সুরমা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শামসুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিজ্ঞতার সনদ জালিয়াতি, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ, অধস্তন শিক্ষকদের হেনস্থাসহ একগাদা অভিযোগ। অবসরের পরেও এখনো নানাভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে প্রভাব বিস্তার করে আছেন বলেও শোনা যায়।
কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, ১৯৯৩ সালে অক্টোবরে ইসলামের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান শামসুল ইসলাম। সেই নিয়োগ পরীক্ষায় একমাত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন তিনি, যা শিক্ষক নিয়োগ বিধি অনুযায়ী বৈধ নয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩য় শ্রেণি অগ্রহণযোগ্য হলেও শামসুল ইসলাম ছিলেন রেফার্ড প্রাপ্ত। এছাড়া চাকরির পদোন্নতির ক্ষেত্রে এমপিওভুক্ত কলেজে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার যে সনদ চাওয়া হয় তাতে অসততার আশ্রয় নেন তিনি।
এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি বিগত ০৭/১০/২০০৩ তারিখে তার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে তা বাতিলের সুপারিশ করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে চার মাসের স্থগিতাদেশ পান শামসুল ইসলাম। তবে এরপর আর এই মামলায় কোনো অগ্রগতি হয় নি। এই অবস্থাতেই অধ্যক্ষ পদে আসীন হওয়া, চাকরি সরকারীকরণ, তারপর অবসর। অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেবার পর থেকে কলেজের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন শামসুল ইসলাম, গড়ে তোলেন নিজস্ব বলয়। কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করলে বেতনবন্ধসহ একাধিক উপায়ে হেনস্থা করতেন তিনি।
সরেজমিন দক্ষিণ সুরমা কলেজে গিয়ে বিভিন্নজনের সাথে আলাপ করে জানা যায়, এখনো তার ভয়ে মুখ খুলতে চান না কেউ।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক জানান, কলেজে থাকাকালীন সময় নিজের খেয়ালখুশি মতো কলেজ পরিচালনা করতেন তিনি। তার বলয়ের শিক্ষক কর্মচারীরা কাজ না করলেও বেতন ভাতা ঠিকই থাকতো। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধাচরণ করায় অন্তত দুই বছর ধরে বেতন আটকে রেখেছিলেন এক শিক্ষিকার। নিজে অবসরে যাবার পরেও সেই শিক্ষিকার বেতন-ভাতা চালু হবার ক্ষেত্রে নানা তদবির করে আটকে রাখেন।
এছাড়া করোনার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও নিয়মিত যানবাহনসহ অন্যান্য ভাতা তুলে নিয়েছিলেন শামসুল ইসলাম।
এসব অভিযোগের সত্যতা জানতে দক্ষিণ সুরমা কলেজের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের সাথে দেখা করলে তিনি অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে নিলেও বিস্তারিত বলতে চান নি। তিনি বলেন, তাঁর একটি মামলা চলমান রয়েছে এমন তথ্য আমাদের কাছে থাকলেও সর্বশেষ অবস্থা আমার জানা নেই। তাছাড়া তাঁর নিয়োগের সময় আমি এই কলেজে ছিলাম না, এসব নিয়ে তদন্ত হচ্ছে শুনেছি। তবে এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না।
এদিকে উচ্চ আদালতে রিটের ব্যাপারটি সুরাহা না হলেও কিভাবে তার চাকরি সরকারি হয়েছে, পদোন্নতি পেয়েছেন এবং অধ্যক্ষ হয়েছেন এসব ব্যাপারে সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) একটি অফিস আদেশ জারি করে এর ব্যাখ্যা চেয়েছেন। তবে সেই অফিস আদেশের জবাব না দিয়ে উল্টো মাউশিকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সাবেক এই অধ্যক্ষ।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ সুরমা কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ মো. মোছাব্বির আহমেদ বলেন, ‘ওনার নিয়োগ কিভাবে হয়েছে তা আমার জানা নেই। মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন, অর্থমন্ত্রণালয় এবং মাউশির নির্ধারিত প্রক্রিয়াতেই তার চাকরি সরকারি হয়েছে, তার পিআরএল অনুমোদন হয়েছে। তবে মাউশির অফিস আদেশ পেয়ে আমি ওনাকে (শামসুল ইসলাম) চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনো জবাব পাইনি।’
তবে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো একেবারেই অসত্য বলে দাবি সাবেক অধ্যক্ষ শামসুল ইসলামের। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপে তিনি বলেন, ‘আমার নিয়োগ নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন সেটা সঠিক নয়। আমি দক্ষিণ সুরমা কলেজে যোগদান করেছি ১৯৯৩ সালে, আর কলেজ এমপিওভুক্ত হয় ৯৪ সালে। এর আগে ১৯৯০ সাল থেকে আমি বিয়ানীবাজার নবীব আলী কলেজে শিক্ষকতা করেছি, যার অভিজ্ঞতার সনদ দেয়া হয়েছে।’
তবে নবীব আলী কলেজ এমপিওভূক্ত ছিলোনা তাই এই অভিজ্ঞতার সনদ কার্যকর কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই কার্যকর। দুটি কলেজ একই সাথে এমপিও হয়েছে। এছাড়া নিয়োগবিধিতে কোথাও উল্লেখ নেই যে একক প্রার্থী হওয়া যাবে না।’
সম্প্রতি মাউশি থেকে অফিশ আদেশে ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি রিট করেছি, আদালত এতে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। এরপর রিট শুনানি করাতো আমার কাজ নয়, এটাতো আদালতের ব্যাপার। মাউশি আমার কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা চাওয়াটা আইনের ব্যত্যয়। আমি লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছি। মাউশির ওই কর্মকর্তা কিসের ভিত্তিতে আমার কাছে ব্যাখ্যা চান তার জন্য আমি আইনি ব্যবস্থা নেবো।’