দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ২৬ জন মানুষ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও প্রস্তুত, অপেক্ষা করছিলেন ‘পাপা টাইগার’ এর আগমনের।
ভোরের সূর্য যখন সবুজ টিলার ঘেরা বাংলোটিতে পড়ে, তখন অনেকেই উৎকন্ঠিত হয়ে পড়েন। কেউ আশ্বস্ত করেন যে ‘তিনি’ ভারতের আগরতলা থেকে আসছেন আর বৈঠকটি পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক সকাল ১০টাতেই শুরু হবে।
দিনটি ছিল এপ্রিলের ৪। সাল ১৯৭১। স্থান হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলো।
এর আগের কয়েক সপ্তাহে দেশে ঘটে গেছে অনেক কিছুই। ২৫ মার্চের কালরাত থেকে নিরীহ বাঙালিদের উপর হত্যাযজ্ঞে নেমেছে পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনী। বৈঠকের জন্য অপেক্ষমাণ অনেকেই ততক্ষণে পেয়েছেন স্বজন হারানোর খবর, অনেকেই ক্ষুব্ধ, বাকরুদ্ধ এ হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতায়।
এরই মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা এক নতুন আশা জাগিয়েছে সবার মধ্যে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের মধ্যে এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত নতুন প্রত্যাশা তৈরি করেছে।
ঠিক পরিকল্পনা মোতাবেক সকাল ১০টায় শুরু হয় বৈঠক। সভাপতিত্ব করেন ‘পাপা টাইগার’, কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। গুরুত্বপূর্ণ সে বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো সেদিন।
সিদ্ধান্ত হয়েছিলো দেশকে চারটি ভাগে ভাগ করে চারজন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশের প্রশিক্ষিত বাঙালিদের নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার। পাশাপাশি দ্রুত সাধারণ যুবকদের যুুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সিদ্ধান্ত হয় পাকিস্তানী বাহিনীর উপর ধারাবাহিকভাবে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে যাওয়ার, এবং শুধুমাত্র উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সম্মুখ সমরে যাওয়ার। পরবর্তী ১০ এপ্রিল আবারও বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সে বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় পাপা টাইগার মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার। এ বৈঠকেই গুরুত্বারোপ করা হয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার উপর।
সেদিন তেলিয়াপাড়া চা বাগানের এই বাংলোকে প্রথম সেক্টর-৩ এর সদরদপ্তর ঘোষণা করা হয় আর এ সেক্টরের দায়িত্ব পান মেজর কেএম শফিউল্লাহ। পাকিস্তানী বিমানবাহিনীর হামলার পরিত্যক্ত ঘোষণার আগে ২১ জুন পর্যন্ত এই বাংলো সেক্টর সদরদপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলো।
বিজয়ের পর এ বাংলোর সামনে নির্মাণ করা হয় বুলেট আকৃতির একটি সৌধের যা মহান মুক্তিযুদ্ধে এই স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে ধারণ করে রেখেছে। বাংলো এলাকায় সাধারণের প্রবেশ উন্মুক্ত হলেও বাংলোর অভ্যন্তরে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত। তেলিয়াপাড়া চা বাগান বর্তমান রাষ্ট্রায়ত্ব ন্যাশনাল টি কোম্পানী লিমিটেডের অধীনে।
স্মৃতিসৌধ ছাড়াও এখানে প্রথম সেক্টর-৩, পরবর্তিতে সেক্টর ৪ ও ৫ এর অধীনে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক রয়েছে। আছে এই বাংলোকে ঘিরো মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ফলক।
গতমাসে ৭১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক মধু মৃত্যুর আগে দেয়া এক সাক্ষাৎকার এই ঐতিহাসিক স্থানের মর্যাদা যথাযথভাবে রক্ষার দাবি জানিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘কতটা গুরুত্বপূর্ণ কল্পনা করুন… মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ রব, মেজর সিআর দত্ত, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম রেজা, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কেএম শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শাফায়াত জামিন, মেজর ময়নুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নুরুল ইসলাম বসে বৈঠক করেছেন।’
এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের যাত্রাপথ রচিত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘জানা যায় বৈঠক শেষে জেনারেল ওসমানী তার পিস্তলে গুলি ছুড়েন এবং সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের শপথ নেন।’
এই বাংলোতে একটি স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের দাবি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও হবিগঞ্জের বিশিষ্টজনদের। এ লক্ষ্যে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণের আহবানও জানান তারা।