রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম নৌপথ মাদারীপুরের শিবচরের বাংলাবাজার ঘাট। একসময় প্রতিদিনই লাখো মানুষের পদচারণা ছিল এই ঘাটে। ধীরে ধীরে দিন বদলেছে। আর মাত্র দিন দশেক পরেই খুলে যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। উদ্বোধনের পর সেতু ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার লোকজন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে যাবেন। সেতু ঘিরে ব্যাপক উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে পদ্মা পাড়ের জেলাগুলোতেও। তবে এর প্রভাবে ব্যস্ততা কমছে বাংলা বাজার ঘাটে। আর লোকজনের আনাগোনা কমায় তিন দশকের পেশাও বদলে ফেলছেন ঘাটকেন্দ্রিক বিভিন্ন পেশার মানুষ।
আগামী ২৫ জুন অপার সম্ভাবনার এই পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের দিন স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা করার প্রস্তুতি চলছে। এই জনসভাটিও হবে এই বাংলাবাজার ঘাটে। সম্প্রতি সমাবেশস্থল পরিদর্শন করেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি প্রতিনিধি দল। ওই দলে ছিলেন মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। তিনি ঘাট এলাকা পরিদর্শনকালে বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের অঞ্চলের অর্থনৈতিক মুক্তির সেতু। সেতুটি চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। এর ফলে দুটি নৌবন্দর মোংলা ও পায়রা এবং স্থলবন্দর বেনাপোলকে ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেললাইনও যুক্ত হওয়ায় চিন্তাই করা যাবে না কী ধরনের অর্থনৈতিক তৎপরতা বাড়বে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই অঞ্চলের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে পদ্মা সেতু। গড়ে উঠছে নানান শিল্প করখানা, সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র। তবে স্বাভাবিকভাবেই পেশা বদলে ফেলতে হচ্ছে দীর্ঘদিনের চেনা ঘাটকেন্দ্রিক পেশাজীবীদের। তবে এদের মধ্যে কিছু পেশার মানুষ অন্য সাধারণ কাজে অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা বা পুনর্বাসনেরও দাবি জানিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে তারা সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী দ্রুত পদ্মার পাড়ে মানুষের হাঁটা ও বসার ব্যবস্থা করাসহ একটি পর্যটন এলাকা করার দাবি জানান।
এই ঘাট ঘিরে দীর্ঘদিনে পথচলায় এখানকার বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে গড়ে উঠেছে অনেক নতুন সম্পর্ক, দানা বেঁধেছে নানান স্মৃতি। ঘাটে ব্যবসা করার সুবাদে অনেকের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হয়েছে, ব্যবসায়িক সম্পর্কের পাশাপাশি অনেকের সঙ্গে গড়ে উঠেছে পারিবারিক সম্পর্কও। সবার মাঝে এখন বিদায়ের সুর। তবে তারানতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে জীবনমান উন্নত করতে উদগ্রীব।
সেতু চালু হওয়ায় সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আসবে ঘাট এলাকার দোকানদার, হকার, কুলি, হোটেল ব্যবসায়ীদের। তাদের বড় একটা অংশই মনোনিবেশ করবেন কৃষিতে।
আবার কেউ কেউ ঢাকায় মালপত্র আনা নেওয়া ও পরিবহনের কাজে জড়াবেন। কেউ কেউ বাড়ির পাশে দোকান দেওয়ারও পরিকল্পনা করছেন।
সম্প্রতি ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এরই মধ্যে ঘাটের খাবার হোটেলগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক দোকানপাটও ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই দোকানপাট অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়েছেন। দুই-একটা চায়ের দোকান খোলা থাকলেও ক্রেতা নেই তেমন একটা। যারা আছেন ঘাট এলাকায় কথা হলো তাদের সঙ্গে।
পদ্মা সেতু নিয়ে তাদেরও আশার অন্ত নেই। ঘাটের তিন নম্বর ফেরি ঘাটের হোটেল ব্যবসায়ী আবদুর রব হাওলাদার বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর আমাগো স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এর থেকে খুশির আর কী হতে পারে।’
এমন সাহসী উদ্যোগের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতেও ভুললেন না ঘাটের বিসমিল্লাহ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক আল আমীন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি সাহসী উদ্যোগ নিয়ে এত বড় একটি সেতু নির্মাণ করেছেন।’
আবার নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য সরকারের কাছে উদ্যোগও চাইলেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, এই ঘাটকে ঘিরে যারা জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাদের মধ্যে হকার শ্রেণির ব্যবসায়ীরা লঞ্চ, ফেরিতে ঘুরে ঘুরে যাত্রীদের কাছে আখের রস, ঝালমুড়ি, ছোলা, সেদ্ধ ডিম, সিঙারা, নারকেল-চিড়া, শসা, দইসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার বিক্রি করতেন। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে প্রতিটি লঞ্চে তিন থেকে চার জন করে নানান জিনিস নিয়ে ওঠে খাবার বিক্রি করতেন তারা। ঘাটের পন্টুনে ঘুরে ঘুরেও খাবার বিক্রি করতেন অনেকে। ঘাট দিয়ে যাতায়াতকারী হাজার হাজার যাত্রীই ছিল তাদের ক্রেতা। ঘাট বন্ধ হলে তাদের অন্য পেশায় যেতে হবে।
তারা বলছেন, ঘাট বন্ধ হলেও নতুন করে মহাসড়ক দিয়ে বাসসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল বাড়বে। তাদের অনেকের ব্যবসা এখন মহাসড়কের স্থানীয় বাস স্ট্যান্ডকেন্দ্রিক গড়ে উঠবে।
হারুন নামে এক ছোলা বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি বলেন, বিকল্প পেশা নিয়ে সেতু নির্মাণের শুরু থেকেই তাদের অনেকের ভাবনা চলছিল। আর মাত্র কয়েক দিন পরেই সেতুর উদ্বোধন। ইতোমধ্যে অনেকে বাড়ির কাছাকাছি ছোট্ট দোকান দিয়েছেন। আমিও কিছু টাকা জমিয়েছি, আর কিছু টাকা আত্মীয়র কাছ থেকে এনে নিকটস্থ বাংলাবাজার ঘাটে একটি দোকান দেবো।
ছয়ফুল মোল্ল্যা নামে এক চানাচুর বিক্রেতা বলেন, আমার পরিবারের অনেকেই অনেক বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে ওই ব্যবসা সময় দেবো।
মনির নামে আরেকজন বলেন, ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে কেউ কেউ কৃষি কাজে যোগ দেবেন। পাশাপাশি আমরা পদ্মায় মাছ শিকার করে চলতে পারবো। অনেকেই ঢাকা শহরের দিকে ছুটছেন। এছাড়া কয়েকজন ইতোমধ্যে পাসপোর্ট করে দেশ ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন।
লঞ্চ টার্মিনালে বসে বিভিন্ন ধরনের মসলা ও শস্য বিক্রি করেন হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ৮ বছর ধরে এই পেশায় আছি, ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে শুনেছি। তবে এখনও বিকল্প চিন্তা করিনি। দেখি বাড়ির কাছে ছোট একটি দোকান নেওয়া যায় কিনা।
অটোবাইক চালক জসিম বলেন, ‘যানবাহন ও যাত্রীর সমাগম যত বেশি হয়, আমাদের আয়ও তত বেশি। বর্তমানে ঘাটে যানবাহনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় যাত্রী নাই, কারা যাইবো?’ তবে সেতু চালু হলে বাস চলাচল শুরু হলে হাইওয়ে থেকে স্থানীয় বাজারগুলোতে যাত্রী আনা-নেওয়া করা যাবে বলে মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে শাখা সড়কগুলো দ্রুত উন্নয়ন করারও দাবি জানান এই চালক।
বাংলাবাজার লঞ্চঘাট সূত্রে জানা যায়, নৌরুটে ৮৭টি লঞ্চ, ১২৫টি স্পিডবোট, ৫-৬টি ফেরি বর্তমানে চলছে। এ সব নৌযানে প্রায় ১২শ’ শ্রমিক কাজ করেন। এসব শ্রমিকদের অধিকাংশ মাদারীপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা। ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে অনেককেই পেশা ছাড়তে হবে।
বিআইডব্লিউটিএর বাংলাবাজার ঘাটের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আক্তার হোসেন বলেন, এখনও ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে কিনা তেমন কোনও নির্দেশনা আমাদের কাছে আসেনি। যদি সরকার চায় তাহলে ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন