তরুণদের নিখোঁজ হওয়ার প্রবণতা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও সরকারের হস্তক্ষেপে যেসব জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ হয়েছে এবং যাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে, সেসব দলের সদস্যরা নতুন প্ল্যাটফর্ম করার চেষ্টায় আছে। নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) এর কার্যক্রম তাদের এধরনের তৎপরতার প্রমাণ। ২০১৯ সালে থেকে নানা ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে আসলেও ২০২২ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া কিশোর তরুণদের সন্ধান চালাতে গিয়ে এই তথ্য জানতে পারে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যখন কোনও একটি জঙ্গি সংগঠন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনগণের সামনে চলে আসে এবং সেই সংগঠনের ব্যানারে কাজ করা দুষ্কর হয়ে যায় তখন তারা সেই সংগঠন ছেড়ে অন্য একটি সংগঠনে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালায়। তাদের রিক্রুট করা নতুন সদস্যরা, যারা বয়সে কিশোর ও তরুণ, কথিত হিজরতের উদ্দেশ্য ঘর ছেড়ে যারা জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছে তারা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নানা ধরনের শঙ্কা অবশ্যই রয়েছে। নতুন কিংবা পুরাতন যে জঙ্গি সংগঠনই হোক না কেন যতদিন পর্যন্ত আইডিয়োলজি বা আদর্শ দূর করা সম্ভব না হবে, ততদিন পর্যন্ত বুঝতে হবে পটেনশিয়াল রেডিক্যালাইজড পিপল তৈরি হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির জায়গাটি আরও শক্ত করা উচিত। তাহলেই এসব বিষয় দমিয়ে রাখা সম্ভব হবে।

কুমিল্লায় প্রায় একই সময়ে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয় সাত তরুণ। এর মধ্যে চারজনে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার কথা জানতে পারেন গোয়েন্দারা। বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন থেকে কিছু সদস্যদের একীভূত করে ২০১৭ সালে এই নব্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সাল থেকে সংগঠনটি এই নামে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলো। বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া কিশোর ও তরুণরা এই সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়। র‌্যাব বলছে, কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে এসব কিশোর ও তরুণদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নির্জন স্থানে। তাদের দেওয়া হচ্ছে শারীরিক প্রশিক্ষণ। যুক্ত করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নাশকতা মূলক কার্যক্রমের লক্ষ্যে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, নিজেদের দলে ভেড়াতে জঙ্গিদের কৌশল মোটামুটি একই ধরনের। সন্তানদের বিষয়ে আরও বেশি খোঁজখবর রাখতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যারা যোগাযোগ করছে তাদের বিষয়ে পরিবারের তথ্য জানা থাকতে হবে। এছাড়া কোন ধরনের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে চলাফেরা করছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে এসব বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ রাখতে হবে পরিবারকে। সন্তানদের হঠাৎ গতিবিধির পরিবর্তন কিংবা আচরণগত পরিবর্তন এলে সেসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে যাচাই করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ধরপাকড় ও অ্যাকশন দিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোকে পুরোপুরি দমিয়ে রাখতে পারবো না আমরা। জঙ্গি সংগঠনের যে আইডিয়োলজি আছে তা নষ্ট করা যদি সম্ভব না হয়। যদি নষ্ট করতে হয়, তাহলে যারা ধরা পড়ছে তাদের তৎক্ষণাৎ ডি-রেডিক্যালাইজ করতে হবে। সমাজের স্টেক হোল্ডারদের একত্রিত করে সমন্বয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের আদর্শ দূর করার চেষ্টা করা উচিত। পটেনশিয়াল রেডিক্যালাইজড পিপল যাতে তৈরি না হয় সেই চেষ্টা করা উচিত।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুর রশিদ বলেন, বাসা থেকে বেরিয়ে কিশোর ও তরুণরা কোথায় গেল, কেন গেল, কারা তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও জঙ্গিবাদে দীক্ষিতের চেষ্টা করছে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে। পুরো নেটওয়ার্ক উন্মোচন করাটা হচ্ছে আমাদের জননিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রিক্রুট করা নতুন কিশোর ও তরুণদের কথিত হিজরতের উদ্দেশ্য নিয়ে যাওয়া ও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘটনা জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি অপারেশন্স হায়দার আলী খান বলেন, যেসব কিশোর ও তরুণ নিখোঁজ রয়েছে, তাদের শনাক্তে কাজ করা হচ্ছে। কোথায় তাদের অবস্থান, কাদের প্ররোচনায় বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে সব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে অভিযান চলমান রয়েছে। কোনও কিশোর ও তরুণ নিখোঁজের নামে আত্মগোপনে রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন