তবারক হোসেইনের ‘খোলাসা বয়ান’ গ্রন্থের অন্তরঙ্গ পাঠ

খোলাসা কথায় অনুষ্ঠিত হলো ‘খোলাসা বয়ান’ গ্রন্থের অন্তরঙ্গ পাঠ অনুষ্ঠান। শনিবার বিকেলে সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে টানা সাড়ে ৩ ঘন্টা গ্রন্থ ও গ্রন্থ প্রণেতা তবারক হোসেইনকে নিয়ে আলোচনা করেন অতিথিরা। গ্রন্থের প্রাসঙ্গিকতা, প্রেক্ষাপট এবং সার্বিক বিষয়ে যেমন পর্যালোচনা করেন অতিথিরা তেমনই লেখকের জীবনের বিভিন্ন দিকও উঠে আসে আলোচনায়।

অনুষ্ঠান দীর্ঘ হলেও ভাটা পড়েনি উপস্থিতিতে। এক সময়ের তুখোড় সাংবাদিক এবং আইনজীবী তবারক হোসেইনের ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক যুগভেরী এবং দেশবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ দিয়ে সাজানো হয়েছে খোলাসা বয়ান-এর ক্যাম্পাস। তাঁর সাড়ে চার দশক পূর্বের লেখাগুলো যেন আজও প্রাসঙ্গিক। সে কথাই উঠে এসেছে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেনের বক্তব্যে।

তিনি বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম তা-কি সফল হয়েছে? এই প্রশ্নটি যদি তবারক হোসেইন এই বয়সে রাখতে পারেন এবং সুদূঢ় আমেরিকাতে গিয়েও উত্থাপন করতে পারেন, তাহলে সেই মানুষটিকে আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করবো। অবশ্যই তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা। সাহসীতো বটেই। তাই তার নামের পাশে দি শব্দটি অনায়াসেই যুক্ত করা যায়। তিনি বলেন, খোলাসা বয়ান তার যৌবন কালের লেখা। কিন্তু এই বইয়ের মধ্যে যা আছে তার ভাষা যদি আমরা একটু বদলে দেই, তাহলে সেগুলো মনে হবে একেবারে সমসাময়িক, আজকের। এই বইয়ের প্রথম পাতা থেকে শুরু করে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ে আমি দেখেছি যে, এটা আজকেরও হাহাকার। তিনি বলেন, একজন সাংবাদিককে ছিদ্রান্বেষী হতে হয়। সমাজের কোথায় ছেদা আছে সেটা পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখার দায়িত্ব সাংবাদিকদের। কোথাও দুর্নীতি হচ্ছে কিনা, কোথাও বৈষম্য হচ্ছে কি-না, প্রশাসনের গলদ আছে কি-না, সমাজটা ভেঙে পড়ছে কি-না এসব চিত্র যাদের চোখে ভাসে তারাই কলম সৈনিক।

খোলাসা বয়ানে সে কথাগুলোই দৃঢ়তার সাথে বলতে পারার সাহস দেখিয়েছেন তবারক হোসেইন, তা সকলে পারেন না, সবার পক্ষে সম্ভব নয়। সে কারনেই তিনি অনন্য। অন্যদের চেয়ে আলাদা। তিনি অন্য অনেক মানুষের চেয়ে ভালো মানুষ।

বিশিষ্ট লোক গবেষক অধ্যাপক কবি ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা পর্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক অধ্যাপক সুনির্মলকুমার দেব মীন, কবি ও গবেষক এ কে শেরাম, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন।

অনুষ্ঠানে নির্ধারিত আলোচক ছিলেন, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মিহির কান্তি চৌধুরী, দৈনিক সিলেট মিরর’র সম্পাদক আহমেদ নূর, দৈনিক উত্তর পূর্ব’র নির্বাহী সম্পাদক তাপস দাস পুরকায়স্থ, সাংবাদিক অপূর্ব শর্মা। এছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন জাসদ নেতা লোকমান আহমদ।

স্বাগত বক্তব্য উৎস প্রকাশনের সত্ত্বাধিকারী মোস্তফা সেলিম গ্রন্থ প্রকাশের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, এ গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে উৎস প্রকাশন একটি দায়িত্ব পালন করেছে। সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং কৃষ্টিকে ধারাবাহিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরার যে অভিযাত্রা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি এটি তারই অংশ। তিনি নাগরী লিপির প্রচারের ক্ষেত্রে সংস্থাটি ভূমিকাও তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি সুনির্মল কুমার দেব মীন তার বক্তব্যে বলেন, ‘যে মানুষ আজীবন প্রতিবাদী ছিলেন, তিনি সঠিক কথাটিই লিখবেন-আমরা এটা বিশ্বাস করতে পারি। আশা করছি, তবারক ভাই স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থও রচনা করবেন। এতে সমাজ-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হবে। তবারক হোসেইনের আজকের অগ্রযাত্রার পেছনে তার সহধর্মিনীর ভূমিকাও কোন অংশে কম নয়। তার সাহচর্যই আজকের তবারক হোসেইনকে বিনির্মাণ করেছে।

কবি এ কে শেরাম বলেন, ‘তবারক হোসেইন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পুরোধা ছিলেন। সাংবাদিক অঙ্গনেও তাঁর বিচরণ ছিল। তার খোলাসা বয়ান বইটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের একটি অনন্য দলিল। সেই সময়ের সমাজ জীবনের কথা যেমন উঠে এসেছে গ্রন্থে, তেমনই অনাচার-অবিচারের কথাও স্থান পেয়েছে। তিনি নির্মোহভাবে উপস্থাপন করেছেন তার বক্তব্যে।

জাসদ নেতা লোকমান আহমদ বলেন, ‘খোলাসা বয়ান পড়ার সময় আমি বারবার সেই দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলাম। ৪৯ বছর পরও এই গ্রন্থ প্রাসঙ্গিক থাকার কারণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের চালিকা শক্তি আজও পরিবর্তিত হয়নি। চালিকা শক্তি পরিবর্তিত না হলে আরও ৪৯ বছর প্রাসঙ্গিক থাকবে বইটি। আমাদের এই বই থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। যা আমাদেরকে শুধু ঋদ্ধ করবে না, পথও দেখাবে।

দৈনিক সিলেট মিরর-এর সম্পাদক আহমদ নূর বলেন, সাংবাদিকতায় আমার গুরু দুইজন। একজন তবারক হোসেইন। অন্যজন মতিউর রহমান। ১৯৮৮ সালে আমি সাংবাদিকতা ছেড়ে দিই। কিন্তু তবারক ভাই আমাকে টেনে নিয়ে আসেন। তিনি যদি সেদিন আমাকে সংবাদপত্রের সাথে সম্পক্ত না করতেন তাহলে আজ হয়তো আমি সংবাদপত্র জগতের সাথে সম্পৃক্ত থাকতাম না। এজন্য তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

বই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, খোলাসা বয়ান নামের মধ্যেই বইটিতে কি আছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন। কোনো রাখঢাক করে বলেন নি। স্বাধীনতা পরিবর্তী সময়ে যে বাস্তবতার কথা তিনি বলেছেন, তা আজো একই রকমের আছে। তাই তার বইটিকে আমি বর্তমান সময়ের জন্যও প্রাসঙ্গিক মনে করি।

দৈনিক উত্তর-পূর্বের নির্বাহী সম্পাদক তাপস দাশ পুরকায়স্থ তবারক হোসেইনের ব্যক্তিগত স্মৃতি তর্পন করে বলেন, তবারক হোসেন একজন প্রতিবাদী মানুষ। নিজ আদর্শ থেকে তিনি কখনোই বিচ্যুৎ হননি। আদর্শের প্রতি তিনি এতোটাই অবিচল ছিলেন যে, ১৯৭৪ সালে সিলেট মাদ্রাসা মাঠে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে একজন স্বাধীনতা বিরোধী কবি কবিতা পাঠের জন্য মঞ্চে উঠলে চাইলে তাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করেন তিনি। শুধু তাই নয়, মঞ্চ থেকে তাকে বের করে দেন তিনি। তার লেখা এই গ্রন্থ প্রকাশনার মধ্য দিয়ে উৎস প্রকাশন তাঁকে উজ্জীবিত করেছে বলে আমি মনে করি। এজন্য প্রকাশনার সত্ত্বাধিকারীকে ধন্যবাদ জানাই।

মিহির কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘আমার জীবনের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রয়েছে তবারক হোসেইনের। আমার শিক্ষকতায় আসার ক্ষেত্র তিনিই তৈরি করে দিয়েছিলেন। অন্যথায় আজ হয়তো আমি ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিতি হতাম। এই বইয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের নানা সংস্কারের যেমন দাবি আছে, তেমনি আছে হিউমার। এক সময় এ অঞ্চলের অনেক কিছুতেই তবারক ভাইয়ের প্রভাব ছিল। তিনি তার প্রভাবকে ইতিবাচক ভাবে কাজে লাগিয়েছেন। যাতে করে উপকৃত হয়েছে সমাজ।’

তবারক হোসেন সাংবাদিকতার সাথে তার সম্পৃক্ত হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, আমি যখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন ছাত্র আন্দোলনের একটি খবর সংবাদ পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। ৩ দিন পর সেই সংবাদটি প্রকাশিত হয়। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেই খবরটি যদি সংবাদে না প্রকাশ না হতো তাহলে হয়তো আমি সাংবাদিক হতাম না।

সাংবাদিকতা জীবনের নানা প্রসঙ্গের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি এ কথা গভীরভাবে বিশ্বাস করি একজন সাংবাদিকের কোনো বন্ধুও নেই, শত্রুও নেই। সাংবাদিককে যাহা দেখিবো তাহাই লিখিবো- মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে। আমি নিজের জীবনে এটা ধারণ করার চেষ্টা করেছি। সে কারণে কঠিন সময়েও আমি নিজ দায়িত্বের প্রতি অবিচল থাকার চেষ্টা করেছি। সেই সময় অধিকাংশ কলামই ছদ্মনামে লেখা হতো, কিন্তু আমি সে পথে হাটিনি। আমি আমার নামেই সাপ্তাহিক যুগভেরীতে খোলাসা বয়ান লিখতে শুরু করি। সেদিন লিখেছিলাম বলেই আজ এটি প্রকাশ করা সম্ভব হলো।’

এজন্য সাংবাদিক আহমদ নূর, ইখতিয়ার উদ্দিন এবং উৎস প্রকাশনের সত্ত্বাধিকারী এবং লোকসংস্কৃতি গবেষক মোস্তফা সেলিমের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি আগামীতে আত্মজীবনী লেখার ক্ষেত্রে এই অনুষ্ঠান তাকে অনুপ্রাণিত করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।