ডায়াবেটিসে বাড়ছে বিষণ্ণতা ও হৃদরোগের শঙ্কা

জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিতে এমনিতেই মানুষ হাঁসফাঁস করছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি বেড়েছে চিকিৎসা ব্যয়ও। এ অবস্থায় এক কোটি ৪০ লাখ মানুষের উপর চেপে বসেছে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় খরচের বোঝা।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) মতে, দেশে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। আর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাবে ষাটোর্ধ্ব কোনো ডায়াবেটিস রোগীর পেছনে মাসে ব্যয় হয় ১৪ হাজার ১১৮ টাকা।

এ অবস্থায় প্রতিবছরের মতো আজ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আগামীতে নিজেকে সুরক্ষায় ডায়াবেটিসকে জানুন’ অর্থাৎ ‘Education to Protect Tomorrow’‘.

আইডিএফের হিসাব বলছে, ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্থান শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। কিন্তু আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, ২০৩০ ও ২০৪৫ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে থাকবে। পৃথিবীতে বর্তমানে উচ্চ হারে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে।

বিআইডিএস বলছে, মানুষ খরচের বোঝা সামলাতে না পেরে বিষণ্ন থাকছে। এর ফলে রোগীদের মধ্যে অনেকেই শেষ পর্যন্ত হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি হিসাব বলছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ বিষণ্ণতায় ভুগলেও ডায়াবেটিক রোগীরা ১৫ থেকে ৩৪ শতাংশ বিভিন্ন মাত্রার বিষণ্নতায় আক্রান্ত। আর বিআইডিএস বলছে, যাটোর্ধ্ব ডায়াবেটিস রোগীদের ৮২ শতাংশই হাতাশায় ভুগছে।

আইডিএফের হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ডায়বেটিস রোগী বৃদ্ধির হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। এরপর রয়েছে চীন ও ভারত।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগী এত উচ্চহারে বাড়ার কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশে খুব দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, মানুষের দৈহিক ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে আনুপাতিক ও কাঙ্ক্ষিত হারের চেয়ে বেশি, মানুষের দৈহিক শ্রম দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানসিক চাপ বেড়েছে অনেক গুণ।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (এসএমএমইউ) অ্যান্ডোক্রাইনোলজির সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার সুযোগ আছে। তবে একবার হয়ে গেলে সারাজীবন এটি নিয়েই চলতে হয়।

ডায়াবেটিসের এই চিকিৎসক আরও বলেন, এই বিপুলসংখ্যক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা ও আরও বেশিসংখ্যক মানুষকে ডায়াবেটিসের হাত থেকে রক্ষা করতে এখনই সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।

ডায়াবেটিস রোগীদের বিষন্নতা নিয়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ বলেন, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ও বিষণ্নতায় ভোগা ব্যক্তিদের এই থেরাপি নিতে কীভাবে সচেতন করা যায় চিকিৎসকদের সে উপায় খুঁজে বের করতে হবে। কোন ভাষায় কথা বললে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ বিষণ্নতা দূর করতে চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হবেন, সে ভাষা জানতে হবে।

ডায়াবেটিস দিবসে (১৪ নভেম্বর, সোমবার) পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া এবারও দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ডায়াবেটিসকে বিশ্বব্যাপী সকল রোগের মাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডায়াবেটিসের কারণে মানবদেহে বাসা বাঁধছে হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণসহ কিডনি ও চোখের নানাবিধ রোগ। ডায়াবিটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতেই ডায়াবেটিসের প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫৩ কোটি, যা ২০৩০ সালে ৬৪ কোটিতে পৌঁছাবে। তাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আগামী দিনে নিজেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

এ প্রেক্ষাপটে এবারের ‘বিশ্ব ডায়াবিটিস দিবস’ এর প্রতিপাদ্য ‘আগামীতে নিজেকে সুরক্ষায় ডায়াবিটিসকে জানুন’ (Education to Protect Tomorrow) –যথার্থ হয়েছে বলে আমি মনে করি।

প্রধনমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘আগামীতে নিজেকে সুরক্ষায় ডায়াবিটিসকে জানুন’ অর্থাৎ ‘Education to protect Tomorrow’ অত্যন্ত সময়োপযোগী হয়েছে বলে আমি মনে করি।

ডায়াবেটিস একটি প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ। কাজেই যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং যাদের নেই উভয়কেই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে জানতে হবে এবং নিজেকে সুরক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে-অতিরিক্ত ফাস্টফুড, চর্বিযুক্ত খাবার খেলে, শারীরিক পরিশ্রম ও নিয়মিত শরীর চর্চা না করলে, স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদেরকে নিয়মিত ব্যায়াম, সুষম খাদ্য খাওয়া, সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন করা ছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ ও ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে।