ডলারের নানা রকমের দরের কারণে রফতানি খাতে অর্থপাচারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও রফতানি খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, রফতানির চেয়ে রেমিট্যান্সের ডলারের দাম ৯ টাকা বেশি। এ কারণে অনেকেই আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ে জড়িয়ে পড়তে পারেন। এতে অনেক রফতানিকারক রফতানি আয় রেমিট্যান্স হিসেবে প্রদর্শন করে দেশে এনে তার ওপর দেওয়া নগদ প্রণোদনার সুবিধাও অন্যায্যভাবে নেবেন বলে জানান তারা।
দেশে আসা রেমিট্যান্স প্রতিডলারে ১০৮ টাকা এবং রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) থেকে কার্যকর হয়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিতিশীলতা কমাতে নেওয়া হয় এ সিদ্ধান্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) শীর্ষ নেতারা গত রবিবার (১১ সেপ্টেম্বর) এক সভায় বিভিন্ন লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দাম যেভাবে নির্ধারণ করেছেন, তাতে রফতানি আয়ের চেয়ে রেমিট্যান্স হয়ে আসা ডলারের দাম ৯ টাকা বেশি।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, রফতানিকারকরা যদি আন্ডার-ইনভয়েসিং করেন (অর্থপাচার) এবং রেমিট্যান্স হিসেবে রফতানি আয় আনেন, তাহলে তারা প্রতি ডলারের বিপরীতে ৯ টাকা বেশি পাবেন, তার সঙ্গে পাবেন আরও ২.৫ টাকার নগদ প্রণোদনা। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যে অনেকেই আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ে জড়িয়ে পড়বেন। শুধু তাই নয়, আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের নতুন নতুন রাস্তাও তৈরি হবে।
সাধারণত বৈদেশিক লেনদেন বাণিজ্যে দুটি প্রক্রিয়ায় অর্থপাচার হয়। এগুলো হলো— বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো (ওভার–ইনভয়েসিং) এবং রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার–ইনভয়েসিং)। দুই প্রক্রিয়ায়ই বিদেশে অর্থপাচার করা হয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, পৃথিবীর কোনও দেশেই একই মুদ্রার দাম একেক জায়গায় একেক রকম, এত ভিন্নতা, এত পার্থক্য নেই। বাফেদার নির্ধারিত ডলারের একক দর আরও জটিল পরিস্থিতির তৈরি করবে। বিশেষ করে রফতানির ডলারের মূল্য সবচেয়ে কম অর্থাৎ ৯৯ টাকা। এতে রফতানিকারকরা নিরুৎসাহিত হবেন। এতে রফতানি কমে যাবে। আন্ডার ইনভয়েসিং (পণ্যের মূল্য কম ধরা হবে) বেড়ে যাবে।
তিনি বলেন, রেমিট্যান্স সংগ্রহ এবং রফতানির বিল নগদায়নের মধ্যে ব্যবধান ৯ টাকা। এরফলে, রফতানি খাত আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ের ঝুঁকির মুখে পড়বে। তিনি উল্লেখ করেন, আন্ডার-ইনভয়েসিংযের মাধ্যমে অর্থপাচারও বাড়বে।
এদিকে রফতানিকারকদের মতে, এই ধরনের একক হার রফতানিকারক, আমদানিকারক এবং দীর্ঘমেয়াদে রেমিট্যান্স প্রবাহের জন্য কোনও সুবিধা বয়ে আনতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক শিল্পের নিট পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রেমিট্যান্স ক্রয়ে ১০৮ টাকা দেওয়া সম্ভব হলে রফতানি আয়ে ৯৯ টাকা দেওয়া সঠিক হয়নি। তিনি মনে করেন, এখানে কেবল ব্যাংক লাভবান হবে। তাছাড়া কেউ লাভবান হবে না। বিশেষ করে রফতানিকারকদের সঙ্গে চরম বৈষম্য করা হয়েছে। এতে দেশের ১৭ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই সিদ্ধান্তের কারণে রফতানি আয় কমে যাবে। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ডলার ক্রয় এবং বিক্রিতে এক টাকার পার্থক্য থাকতে পারে। এর বেশি নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রফতানিকারক বলেছেন, রেমিট্যান্সের চেয়ে ৯ টাকা কম দীর্ঘ সময় কার্যকর থাকলে এটি রফতানি আয়ের ওপর ও রেমিট্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ অনেকেই ডলার থেকে আরও মুনাফা করার জন্য হুন্ডিসহ বিকল্প উপায় খুঁজে বের করবে।
উল্লেখ্য, রফতানিকারদের অনেকের বিদেশে অফশোর অফিস রয়েছে– তারা তাদের আয়ের একটি অংশ সেখানে রাখতে পারে বা রেমিট্যান্স হিসাবে সেই অংশ দেশেও আনতে পারে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে একই মুদ্রার মূল্য একেক জায়গায় একেক রকম। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এলে ডলারের দাম দেওয়া হচ্ছে ১০৮ টাকা। একই ডলার রফতানির মাধ্যমে এলে তার দাম দেওয়া হচ্ছে ৯৯ টাকা। যখন আমদানির জন্য দেওয়া হচ্ছে তখন মূল্য ধরা হচ্ছে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা। আবার ফ্রিল্যান্সারসহ বিদেশ থেকে আসা অন্যান্য আয়ে সর্বোচ্চ ৯৯ টাকা দাম দিচ্ছে। যদিও ফ্রিল্যান্সার ও ডলার আয় করা অন্যান্য খাতের কর্মজীবীরা তাদের আয়ের জন্য আড়াই শতাংশ হারে সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন। এছাড়া যখন কেউ বিদেশে চিকিৎসার জন্য ডলার কিনতে যাচ্ছেন তার কাছ থেকে রাখা হচ্ছে (খোলা বাজারে) ১১৪ টাকা।