সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ বলেছেন, ‘এক অর্থে আমরা জেল হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনও পাইনি। এখন এই বিচার পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো, একটি সুষ্ঠু তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। তবে সেই তদন্ত কমিশন হতে হবে সর্বজনগৃহীত। যারা জনগণের কাছে, বাংলার মানুষের কাছে, নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক তথ্য পরিবেশন করবে। মানুষের মধ্যে আমরা আস্থার সৃষ্টি করে পারি। যাতে করে ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বরের মতো হত্যাকাণ্ড আর যেনো দেশের মাটিতে না ঘটে।’
বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) বেলা ১১টায় রাজধানীর চকবাজার পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারের মধ্যে নিহত চার নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষ তিনি এসব কথা বলেন।
সোহেল তাজ বলেন, ‘এই হত্যার সম্পূর্ণ তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ আমরা দেখেছি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর মিলিটারি শাসক গোষ্ঠী জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। ফলে বিচারের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হলো। পরবর্তী সময়ে বিচারকাজ শুরু হলেও ২০০১ সালে এই বিচারকাজকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করে প্রহসনমূলক একটা রায় দেওয়া হলো ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেন। বিচক্ষণ ও দূরদর্শিতার সঙ্গে তারা সরকার পরিচালনা করেছেন। তখন এমন একটি বৈরী অবস্থা, যখন গ্লোবাল পলিটিক্যাল অবস্থা মুহূর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছিল, সোভিয়েত, রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্ব স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল।’
জাতীয় চার নেতার অবদানের কথা উল্লেখ করে সোহেল তাজ বলেন, ‘এক কোটি শরণার্থীকে সামলানো, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, অস্ত্রসজ্জিত করা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে যারা আমাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনে দিয়েছেন ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, বঙ্গবন্ধুর সেই ঘনিষ্ঠ চার সহচর জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো! বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার মাত্র তিন মাসের মাথায়! অবশ্যই এই দুই হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাথা।’
২০০৮ সালে আবারও রায়ের অ্যাভিডেন্স, তথ্য ও সাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে বিভিন্নভাবে তথ্য-প্রমাণ গায়েব করা হয়। যে কারণে ২০১৪ সালে আপিল বিভাগ বাধ্য হলো নিম্ন আদালতে রায় বহাল রাখতে।’
তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম যেন এই বিশ্বাস নিয়ে বড় হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তিতে একটি সুন্দর, দুর্নীতিমুক্ত, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনামুক্ত সমাজ চাই। যে স্বপ্ন নিয়ে আমাদের লাখ লাখ শহীদ তাদের জীবন দিয়েছে। আমরা যেন সেই সোনার বাংলা গঠন করতে পারি।’
জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান জারি করে এই বিচার নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনিও এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের মানুষ কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সোহেল তাজ বলেন, ‘আমাদের সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে বের করে নিয়ে আসা উচিত যে হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা ছিল, কীভাবে কী হয়েছে। আমি মনে করি সবার সবকিছু জানার অধিকার আছে। সম্পূর্ণ তদন্ত করে বের করতে হবে। সত্য কিন্তু তিতে হয়। সবকিছু তুলে আনতে হবে।’
কমিশন গঠনের বিষয়টি বিএনপি প্রহসন বলছে, এতে তারা বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় তদন্ত কমিটি যেটা করা হবে, সেটি হতে হবে গ্রহণযোগ্য। এমন মানুষ দিয়ে তদন্ত করতে হবে, যিনি সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য; এখানে যেন কোনও সন্দেহের অবকাশ না থাকে। এটা জাতির জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ।’
ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর নাতি প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমপুত্র তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘জাতীয় চার নেতার খুনিরা বিদেশে পলাতক রয়েছে। আমাদের দাবি এই ১০ খুনিকে ফেরত আনতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু বিশ্বের বড় দেশগুলো মানবতার কথা বলে, আমাদের জাতীয় চার নেতার পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি আহ্বান, আপনাদের দেশে খুনিরা লুকিয়ে আছে। তাদের অবিলম্বে ফেরত পাঠানো হোক এবং বিচার করা হোক।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের কুশীলবরা আছেন। তাদের মুখোশ উন্মোচন করা হোক। এ জন্য সংসদ ও এর বাইরে আমরা দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের আইনমন্ত্রী বলেছেন, ডিসেম্বর মাসে একটি কমিশন গঠন করা হবে। এই কমিশনের মাধ্যমে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের নায়ক, দেশে ও বিদেশে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। নতুন প্রজন্ম জানবে, জাতীর এই চার সূর্যসন্তানকে ও জাতীয় বীরদের, যারা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও মরণের সহচর ছিল, তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।’
কামরুজ্জামানের ছোট ছেলে এহসানুজ্জামান স্বপন বলেন, ‘এই বিচার পেতে আমদের দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই বিচার ২০১৫ সালেও শেষ হয়। আমার মা দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি এই বিচারের অপেক্ষায় ছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য যে তিনি এই বিচার দেখে গিয়েছেন। যদিও তিনি রায় শুনে গেছেন, তবে বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি।’
তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিশন গঠন করা জরুরি। কারণ এর মধ্যে অনেক তথ্য-প্রমাণ নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকেই সাজা পেয়েছেন কিন্তু যারা নেপথ্যে ছিল, তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়নি। তাই একটা কমিশন গঠন করে জাতীয় চার নেতা ও বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে যারা জড়িত ছিল, তাদের পরিচয় জাতিকে জানানোর দাবি জানাই।’