দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ‘জাতীয় ঐক্যর’ ডাক দিতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসতে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।এর অংশ হিসেবে বুধবার তিনি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবেন। পরদিন বসবেন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে।প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই দুই মিটিংয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে ন্যাশনাল ইউনিটির ডাক দেবেন।”
একই লক্ষ্যে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ছাত্রনেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করন বলে জানান প্রেস সচিব।ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা ৫ অগাস্ট ভারতে চলে যাওয়ার পর দেশের দায়িত্ব নেয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তখন থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে বেশ সরব ভূমিকায় রয়েছে ভারতের গণমাধ্যম; যাকে ‘অতিরঞ্জিত’ এবং ‘সংঘবদ্ধ অপপ্রচার’ হিসাবে বর্ণনা করে আসছে বাংলাদেশ সরকার।সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে দুদেশের সরকারের মধ্যে কয়েকবার বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।সংখ্যালঘুদের আট দফা দাবি আদায়ে মাঠে নামা সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ আরো বেড়েছে।চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের জামিন নাকচের দিন তার সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে হত্যা করা হলে, সেই ঘটনার জন্য ইসকনকে দায়ী করে বক্তব্য দেয় বিভিন্ন দল, সেই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকেও দায়ী করা হয়।
এর মধ্যে সোমবার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশন কার্যালয়ে হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠনের হামলা হয়, যাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ হিসেবে বর্ণনা করে ‘ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া’ জানিয়েছে বাংলাদেশ।এই পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে সংলাপে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা।কী বিষয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন প্রধান উপদেষ্টা- এমন প্রশ্নে শফিকুল আলম বলেন, “ইদানিং কিছু ঘটনা নিয়ে বৃহৎ পরিসরে অপতথ্য ছড়ানোর প্রয়াস আমরা দেখছি। অনেকাংশে দেখছি ভারতীয় গণমাধ্যম খুবই আক্রমণাত্মকভাবে এগুলো করছে। সেজন্য জাতীয়ভাবে ঐক্য তৈরি করতে আমাদের বলতে হবে, ‘তোমরা আসো, দেখ কি হচ্ছে।’“একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় ঐক্যটাও ধরে রাখতে হবে। আমাদের দেশকে নিয়ে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এখানে ইমেজের প্রশ্ন আছে। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এ অপতথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে নামতে হবে।”সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে প্রেস সচিব বলেন, “বাংলাদেশ নিয়ে যে ভয়ানক ধরনের মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তার জবাব দিয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে হবে। এটি জাতীয় দায়িত্ব বলে মনে করি।”
বুধবার বিকেল চারটা থেকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ হবে। ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপের সময় এখনো ঠিক হয়নি।গত অগাস্টে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথা হয় জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, “সেসময় প্রধান উপদেষ্টা নরেন্দ্র মোদীকে বাংলাদেশে ভারতীয় সাংবাদিকদের ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাদের অনুসন্ধান করার জন্য বলেন। সেখানে সহিংসতা হচ্ছে কিনা তা খুঁজে বের করতে বলেন।”আমরা ভারতীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা তথ্য পাচ্ছে তাদের পছন্দের বিষয়গুলো যারা পড়ছেন, সেখান থেকে তথ্য নিচ্ছেন। অনেকক্ষেত্রে নাম ছাড়া তথ্য নিচ্ছেন। আবার তারা বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ থেকেও তথ্য নিচ্ছেন।”
প্রেস সচিব বলেন, “নেত্র নিউজ দেখিয়েছে তাদের তথ্যে বড় রকমের গলদ আছে। নয়জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো মৃত্যু সাম্প্রদায়িক কারণে হয়নি। মৃত্যুগুলোর পেছনে ছিল রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত কারণ। সংগঠনটি নেত্র নিউজের প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। তারা এটাও বলেনি যে আমরা ঘটনাগুলো পুনরায় দেখি।”একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান প্রেস সচিব।তিনি বলেন, “আমরা খুবই স্বচ্ছ। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই চোখ, কান, নাক বন্ধ রেখে, বধিরের মত থেকে বলছে, ‘সে (ভারত) যেটাই বলছে সেটাই সত্য।’ আমরা বারবার বলছি, কিন্তু আমাদের কথাটা শুনেও না শোনার ভাব করছে তারা।”
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনে হামলার ঘটনাকে ‘বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচারের ফলাফল’ হিসেবে দেখছেন শফিকুল আলম।তিনি বলেন, “এটার জন্য দায় চাপাব ভারতীয় গণমাধ্যমকে। এ গণমাধ্যম কোনো তথ্য নিশ্চিত হওয়া ছাড়া মিথ্যা অপতথ্য ছড়াচ্ছে। তারা আগেই নির্ধারণ করে দিচ্ছে বাংলাদেশে কী হচ্ছে। অবস্থান পূর্বনির্ধারিত থাকলে বেশি এগোনো যায় না। ফলে ভারতীয় জনগণ সহিংসতা করছে।”আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকেও বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।
ভারতীয় ‘অপপ্রচারের’ বিষয়ে সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, “কূটনৈতিক চ্যানেলে কথাবার্তা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় এর চেয়ে বেশি করণীয় নেই। আমরা আশা করি, আমাদের সিটিজেন গ্রুপ, ডায়াসপোরা গ্রুপ, রাজনৈতিক দল এবং সিভিল সোসাইটির এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত। তারা আমাদের নিয়ে অপতথ্য ছড়াচ্ছে। পুরো জাতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করছে।”এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, “আমরা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। তারা আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী। আমরা মনে করি, এ সুসম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে।”প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও অপূর্ব জাহাঙ্গীর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।