বান্দরবনে আস্তানা গেড়েছে জঙ্গিরা। নব্য জেএমবির পাশাপাশি নতুন সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে আড়ালে সংগঠিত হতে চাইছে তারা। গত দুই মাসের ব্যবধানে হঠাৎ যুবকদের বাসা থেকে বের করে আনা হয়েছে। আর এদের অর্থ যোগানদাতা হিসেবে উঠে এসেছে সিলেটের তিন প্রবাসীর নাম।
নতুন জঙ্গি সংগঠনটি পাহাড়ি অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পাশাপাশি তাদের সবধরনের সহায়তা দিচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ (কেএনএফ)। এসবের পেছনে কলকাঠি নাড়া হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে।
ঘরছাড়া যুবকদের নিয়ে র্যাব ও পুলিশ আলাদাভাবে অনুসন্ধান করেছে। ইতোমধ্যে র্যাব বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আরও ৫২ জনের হদিসও মিলেছে। তারা পুরোপুরি জঙ্গি সংগঠনে প্রবেশ করেছে। তারা বান্দরবানের রোমা ও রোয়াংছড়িতে প্রশিক্ষণের আস্তানা গেড়েছে। এমন তথ্য নিশ্চিত হয়েই এক সপ্তাহ ধরে চার কিলোমিটার এলাকা কর্ডন করে রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অন্তত সহস্রাধিক সদস্য অভিযানে গেছেন বলে জানা গেছে। স্পিডবোটের পাশাপাশি হেলিকপ্টারেও টহল দেওয়া হচ্ছে বলেও জানা গেছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বান্দরবানে ৫০-এর বেশি জঙ্গি অবস্থান করার বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। ইতোমধ্যে অভিযান চালানোর সবধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কেএনএফের পাশাপাশি স্থানীয় সন্ত্রাসীরা ওই জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশয় দিচ্ছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, দেশের কয়েকটি জেলা থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের খোঁজ করতে গিয়ে সম্প্রতি আমরা জানতে পারি তারা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে গৃহত্যাগ করেছে। যারা অধিকাংশই নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় যুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে সংগঠনটির ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদঘাটন হয়েছে চমকপ্রদ তথ্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পুলিশের একটি বিশেষ সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে একটি প্রভাবশালী দেশ থেকে জঙ্গিদের অর্থায়ন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন প্রবাসী সিলেটের। তারা ওই দেশে ব্যবসা করছেন। তাদের পুরো পরিচয় উদঘাটন করা হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে তারা কয়েকবার দেশে এসেছিলেন। পাহাড়ে অবস্থানরত তালিকাভুক্ত জঙ্গিদের পরিবারের সদস্যদের তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ওই সংস্থাটি। এমনকি কয়েক সদস্যকে নজরদারির মধ্যেও রাখা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অনেকেই আবার উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে গেছে। জামিন নিয়ে আবারও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে একাধিক সদস্যকে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জামিনে থাকা জঙ্গিরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। এই জন্য তাদের ধরতে পুলিশের সবকটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জামিনপ্রাপ্ত ছাড়াও বাইরে থাকা অন্য জঙ্গিদেরও ধরতে বলা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দেশ থেকে জঙ্গি নির্মূল করতে। কিন্তু এখনও জঙ্গিরা গোপনে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, পাহাড়ে অনেক জঙ্গি অবস্থান করছে। আমাদের একটি সংস্থা তাদের অবস্থান চিহ্নিত করেছে। আমাদের সবধরনের সহায়তা করছে সেনাবাহিনী। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ বান্দরবানের কয়েকটি এলাকা কর্ডন করে রেখেছে। অভিযানে গেছেন অন্তত সহস্রাধিক সদস্য। স্পিডবোট, নৌকা ও হেলিকপ্টার দিয়ে টহল দেওয়া হচ্ছে। আশা করি অল্প সময়ের মধ্যে জঙ্গিদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, পাহাড়ে অবস্থান করা ৫২ জঙ্গির পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল তৈরি করেছে র্যাব। তাদের মধ্যে কুমিল্লার মো. দিদার, আহাদ, সাখাওয়াত হোসাইন, আমিনুল ইসলাম ওরফে আল-আমিন, মো. আস সামি রহমান, বায়েজিদ, ইমরান বিন রহমান শিথিল, আল-আমিন, ইমরান, যুবায়ের, নিহাদ আবদুল্লাহ, নাহিদ, সালেহ আহমাদ, জহিরুল ইসলাম, সিলেটের তাহিয়াত চৌধুরী, শেখ আহমদ মামুন, সাদিক, হাসান সাঈদ, সাইফুল ইসলাম তুহিন, শিব্বির আহমদ, বরিশালের আরিফুর রহমান, রাব্বী আবদুস সালাম (নীরব), মাহমুদ ডাকুয়া, পটুয়াখালীর জুয়েল মুসল্লি, আল-আমিন ফকির, মো. মিরাজ সিকদার, ওবায়দুল্লাহ সাকিব, মশিউর রহমান ওরফে মিলন তালুকদার, হাবিবুর রহমান, মাদারীপুরের ইয়াছিন ব্যাপারী, আবুল বাশার মৃধা, চাঁদপুরের মো. নঈম হোসেন, ময়মনসিংহের শামীম মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. নাজমুল আলম নাহিদ, খুলনার আল-আমিন, ফরিদপুরের মুহাম্মদ আবু জাফর, ঝিনাইদহের আমির হোসেন এবং মাগুরার আবু হুরায়রা অন্যতম। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। আবার কয়েকজন মাদ্রাসায় পড়ছেন।
র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেখানে অনেক আগে থেকেই চারটি আঞ্চলিক সংগঠন পাহাড়ি জনপদকে নানাভাবে অশান্ত রাখায় ব্যস্ত, সেখানে নতুন করে কেএনএফের অপতৎপরতা আছে। কেএনএফের কর্মকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ ও তথ্যচিত্র পেয়েছে পুলিশের একটি সংস্থা। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা হয়েছে ২০০৮ সালে। তারা বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি সংগ্রহ করেছিল। হাবিবুল্লাহ নামে এক জঙ্গি জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি সংগঠনটির অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি পার্বত্য অঞ্চলের নাইক্ষ্যংছড়িতে প্রায় দুই বছর ধরে একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করছেন। ইতোমধ্যে তাকে ধরা হয়েছে। মূলত তার তথ্যের ভিত্তিতেই পাহাড়ে থাকা জঙ্গিদের বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হই।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ১৯৯২ সালে আফগান ফেরত তিন যোদ্ধা মুফতি আবদুর রউফ, মাওলানা আবদুস সালাম আর মুফতি আবদুল হান্নান প্রতিষ্ঠা করেন হরকাতুল জিহাদ (হুজি)। ১৯৯৯ সালে হুজি কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার চেষ্টা চালায়। যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে দশজনকে হত্যা করে। হামলা করা হয় রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। সংগঠনটির সদস্যরা বেপরোয়া আকার ধারণ করেছিল। পাশাপাশি জেএমবি ও জেএমজেবির তৎপরতা ছিল আরও বেপরোয়া। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ আবদুর রহমান এবং বাংলাভাইসহ জেএমবির ৬ নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হলেও তাদের তৎপরতা থেমে থাকেনি। নব্য জেএমবির পাশাপাশি আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও হিযবুত তাহরীর সদস্যরা এখনও সক্রিয় আছে।