জগন্নাথপুরে ভুয়া ঠিকানায় চাকরি, ৪ শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত

মূলত তারা নেত্রকোনা জেলার স্থায়ী বাসিন্দা। কিন্তু তারা চাকরি করছেন সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায়। ভুয়া নাগরিকত্ব সনদ দিয়ে অন্য জেলার বাসিন্দা দুই ভাই ও দুই বোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি ভাগিয়ে নিয়েছেন। তাও আবার মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক হিসেবে বছরের পর বছর ধরে তারা দিব্যি চাকরিও করে যাচ্ছেন। অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

এদিকে, প্রকৃত তথ্য গোপন করে ভুয়া ও ঠিকানা জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি নেয়ার ঘটনায় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে তোলপাড় চলছে। জগন্নাথপুরের বাসিন্দা না হয়েও সুনামগঞ্জ জেলার কোটায় অন্য জেলার বাসিন্দা নিয়োগের ঘটনায় দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে সরেজমিনে তদন্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। স্থানীয়রা ওই জালিয়াতির সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, জগন্নাথপুর পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের ইসহাকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে মুকুল চন্দ্র সরকার কর্মরত রয়েছেন। ২০০১ সালে তিনি সরাসরি প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের লুদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে ২০১৭ সালে যোগদান করেন অলি রাণী তালুকদার। ২০১৬ সালে মৃদুল চন্দ্র সরকার উপজেলার আশারকান্দি ইউনিয়নের শেওরা- পাঠকুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মিরপুর ইউনিয়নের রতিয়ারপাড়া বাদশা মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১৬ সালে যোগদান করেন ডলি রাণী তালুকদার। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় পাশের পর মৌখিক পরীক্ষায়ও তাদেরকে পাশ করতে হয়েছে। এরপর এ সকল বিদ্যালয়ে তারা যোগদান করেন। পরে পুলিশ ভেরিফিকেশনে তাদের বাড়ি-ঘর, ঠিকানার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। পরবর্তীতে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ করে সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।

পিতার নাম মৃত যামিনী সরকার। তাদের মূল বাড়ি নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার খালিয়াজুড়ি ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামে। অলি রাণী তালুকদার ও ডলি রাণী তালুকদার সম্পর্কে আপন বোন। এর মধ্যে অলি রাণী তালুকদার হলেন মুকুল চন্দ্র সরকারের স্ত্রী ও ডলি রাণী তালুকদার হলেন মুকুল চন্দ্র সরকারের শ্যালিকা। এই দুই বোনের পিতার নাম বরুন চন্দ্র তালুকদার। তাদের মূল বাড়ি নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার নগর ইউনিয়নের তাতিয়া নোওয়াগাঁও গ্রামে। চাকরি ভাগিয়ে নিতে তারা নেত্রকোনা জেলার আসল ঠিকানার তথ্য গোপন করে জালিয়াতির মাধ্যমে জগন্নাথপুরের ঠিকানা দেন। তাদের কেউ জগন্নাথপুরের স্থায়ী বাসিন্দা কখনো ছিলেন না বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চিত করেছেন।

নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার চাঁনপুর গ্রামের মুকুল চন্দ্র সরকার জগন্নাথপুর পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা দেখিয়ে ২০০১ সালে চাকরি পান। তার ভাই মৃদুল চন্দ্র সরকার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের ইসহাকপুর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা দেখিয়ে চাকরি পেয়েছেন ২০১৬ সালে। স্ত্রী আত্মহত্যা প্ররোচণার মামলায় তিনি গেল প্রায় ৪ মাস ধরে সুনামগঞ্জ জেলা কারাগারে আটক রয়েছেন। মুকুল চন্দ্র সরকারের স্ত্রী অলি রাণী তালুকদার উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের পাইলগাঁও গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা দেখিয়ে ২০১৭ সালে পুলে চাকরি পান। মুকুল চন্দ্র সরকারের শ্যালিকা ডলি রাণী তালুকদারও উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের পাইলগাঁও গ্রামের বাসিন্দা দেখিয়ে চাকরি নিয়োগ পান। তাদের সকলেই ঠিকানা জালিয়াতি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বলে জানা গেছে। এটি দণ্ডবিধি আইনের ৪২০/৪৬৭ ও ৪৬৮ ধারার অপরাধ বলে আইনজ্ঞরা জানিয়েছেন। ঘটনাটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর তফশীলভুক্ত অপরাধ বলেও মন্তব্য করেন আইনজীবীরা।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, স্থায়ী বাসিন্দা না হয়েও ভুয়া নাগরিক সেজে অবৈধভাবে বেআইনী চাকরি হওয়ায় স্থানীয় মেধাবীরা সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রার্থী যে উপজেলার স্থায়ী নাগরিক তার প্রার্থিতা সেই উপজেলায় নির্ধারিত হবে।

উপরোক্ত ৪ জনের নিয়োগের ব্যাপারে জগন্নাথপুর পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা গোবিন্দ দেব চলতি বছরের ৫ জুন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। একই দিন তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বরাবরে আরেকটি অভিযোগ দিয়েছেন। এতে তিনি তাদের ভুয়া সনদ ও ঠিকানা জালিয়াতি করে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকরির বিস্তারিত বর্ণনাও দেন।

গোবিন্দ দেব বলেন, তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য জানার পরই অভিযোগ দিয়েছি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে অধিদপ্তর থেকে একজন সিনিয়র কর্মকর্তা সরেজমিনে তদন্ত করে গেছেন। এখন দেখার পালা কর্তৃপক্ষ কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি আইনগতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।

এছাড়াও জগন্নাথপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা বিষয়টির ব্যাপারে সঠিক তদন্ত করে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের নিকট দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জগন্নাথপুর পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. ছমির উদ্দিন লিখিত প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন, মুকুল চন্দ্র সরকার, পিতা- মৃত যামিনী সরকার, জগন্নাথপুর পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা নন। তার মূল বাড়ি নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার চানপুর গ্রামে। ওই পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহীন আহমদও অনুরুপ প্রত্যয়নপত্র দিয়ে লিখেছেন, মৃদুল চন্দ্র সরকার জগন্নাথপুর পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের ইসহাকপুরের বাসিন্দা নন।

উপজেলার ৯নং পাইলগাঁও ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. শাহান আহমদ প্রত্যয়নপত্রে লিখেছেন, অলি রাণী তালুকদার পাইলগাঁও ইউনিয়নের পাইলগাঁও গ্রামের ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নন। ওই ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য আলিম উদ্দিনও প্রত্যয়নপত্র দিয়ে লিখেছেন, ডলি রাণী তালুকদার তার ওয়ার্ডের বাসিন্দা নন। দুই ইউপি সদস্যের প্রত্যয়নপত্রে তাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী মো. মখলুছ মিয়া প্রতিস্বাক্ষরও করেছেন। এ সকল জনপ্রতিনিধিদের সকলেই এই প্রত্যয়নপত্র দেয়ার কথা জানিয়েছেন।

পাইলগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মখলুছ মিয়া বলেন, ‘আমি তদন্তকারী কর্মকতাকে বলেছি অলি রানী ও ডলি রানী তালুকদার আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা নয়। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি।’

এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মুকুল চন্দ্র সরকারের সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘শুধু আমরা ৪ জন কেন, জগন্নাথপুর উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে অন্তত ১০০ জন আছেন যাদের সবার বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ দেয়া হয়েছে, তদন্তও হয়েছে তাদের ব্যাপারে।

কিন্তু কারো বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘তদন্তের পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি শুনিনি।’

তিনি বলেন, ‘জগন্নাথপুরে আছি চাকরির আগে থেকেই। ১৫ বছর ধরে বাসা ভাড়া করে বসবাস করছি। স্থায়ীভাবে বাস করে আসছি।’ তবে মৃদুল চন্দ্র সরকার কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য জানা যায়নি। আর অলি রাণী তালুকদার ও ডলি রাণী তালুকদারের বক্তব্য জানতে চেয়ে কল দেয়া হলেও তাদের দু’জনেই ফোন রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথপুর উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র দাশ বলেন, ‘তারা নাগরিকত্ব নিয়ে চাকরি নিয়েছে। পরবর্তীতে এখানে জায়গা জমি কিনেছে। স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। চাকরির পর জায়গা কিনলে স্থায়ীভাবে বসবাস হয় নাকি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে চাকরি লইছে-পরে জায়গা কিনেছে। সে (মুকুল চন্দ্র সরকার) এখানে আগে টিউশনি করতো, এখন চাকরি নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের চেষ্টা করছে।’

সুনামগঞ্জ জেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এস এম আব্দুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে এক জেলার লোক আরেক জেলায় নিয়োগ পেতে পারে না। এটি গোপন করার মতো বিষয় নয়। আইনে সুস্পষ্ট বলা আছে, তদন্তে প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেয়া হয়।’

কি ব্যবস্থা নেয়া হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘যে কর্তৃপক্ষ চাকরি দিয়েছে- ওই কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবে’।

প্রাথমিক শিক্ষা সিলেট বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো. জালাল উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগটা হল যার বাড়ি যেখানে তার চাকরিও হবে সেখানে। নিজ উপজেলা অথবা অনেক সময় জেলার মধ্যেও পোস্টিং হতে পারে। কিন্তু, যদি কেউ ভুয়া নাগরিকত্ব নিয়ে চাকরি নিয়ে থাকে আর পরবর্তীতে সেটি প্রমাণিত হয়, তাহলে তার চাকরি চলে যাবে। বিধি অনুযায়ী তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা অফিসার (পলিসি ও অপারেশন) মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী মিঞা সরেজমিনে তদন্তের বিষয়ে জানান, ‘তদন্ত করে এসেছি। তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ চলছে। যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেদন দিয়ে দেব। তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি’।