সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বেড়ীবাঁধসহ বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি। বছর বছর ভাঙ্গনের ফলে উপজেলার আশারকান্দি ইউনিয়নের বড় ফেছী বাজার, পাইলগাঁও ইউনিয়নের জালালপুর, পূর্ব জালালপুর (ভাঙ্গাবাড়ি),পাইলগাঁও, কদমতলা, রানীগঞ্জ ইউনিয়নের আলমপুর, বাগময়না, রানীনগর, বালিশ্রী গ্রামের সড়ক, মসজিদসহ বসতবাড়ি নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে।
কয়েক দশকের টানা ভাঙ্গণে উপজেলার এই তিনটি ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থার রাস্তাঘাট, শতাধিক বসতবাড়ি, বাজার, মসজিদ, কবরস্থান, ফসলি জমি কুশিয়ারা নদীর অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। জগন্নাথপুর-বেগমপুর সড়কটি ভাঙ্গাবাড়ী এলাকায় পরপর ৩ বার ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে। এবারও সড়কটি নদী ভাঙ্গনের সম্মুখীন। ফলে যেকোনো সময় এই সড়কপথে যাতায়াত বন্ধ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
এদিকে, বিগত সরকারের সময়ে কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গন কবলিত এলাকার ভাঙ্গাবাড়ি, ফেছি বাজার ও বাগময়না গ্রামে নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হয়। টানা একবছর ধরে ব্লক তৈরি করা হলেও নদীর তীর সংরক্ষণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গণে বিলীন হচ্ছে প্রাচীন গ্রাম খানপুর ও জালালপুর।
টানা ৫ বছর ধরে ভাঙ্গণে বেড়ীবাঁধসহ খানপুর ও জালালপুর গ্রামের প্রায় ১০টি বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। এই দুটি গ্রামের প্রায় ২০টি বসতবাড়ি নতুন করে নদী ভাঙ্গনের হুমকির সম্মুখীন রয়েছে। সরকারি কাগজে নাম থাকলেও একযোগ আগে কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনে সম্পুর্ণই বিলীন হয়েছে গঙ্গানগর ও মধীপুর নামক দু’টি গ্রাম।
গঙ্গা নগর গ্রামের রাইছ মিয়া বলেন, ‘আমার বসতঘরের পাশে কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। হয়ত এবার আমার বাড়িটি ভেঙ্গে নিয়ে যাবে। আমি গরীব মানুষ, একবার বাড়ি ভাঙ্গলে আবার বাড়ি বানানোর সামর্থ নেই।’
জালালপুর গ্রামের রফান উদ্দিন বলেন, ‘ঘরের কাছে কুশিয়ারা নদী, আর ১০ফুট ভাঙ্গলেই আমাদের বাড়িটি ভেঙ্গে নিয়ে যাবে।’
খানপুর গ্রামের গ্রামের সুনুক উদ্দিন বলেন, ‘আমার বাড়িটি ভেঙ্গে নিয়ে গেছে, এখন পরিবার নিয়ে অন্যের বাড়িতে বসবাস করছি।’
পূর্ব জালালপুর গ্রামের কদর আলী বলেন, ‘কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনে দুই বার বসতবাড়ি হারিয়েছি, আবার যে কবে নিজের বাড়ি হবে জানা নেই।’
বছর বছর কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গণ অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন এলাকা ভাঙ্গনের সম্মুখীন হচ্ছে। এরমধ্যে টানা নদী ভাঙ্গণে উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের রানী নগর, বাগময়না ও বালিশ্রী গ্রামের মসজিদ, বসতবাড়ি, চলাচলের সড়ক, আবাদি জমি ভেঙ্গে নদীতে পরিণত হয়েছে।
রানীনগর গ্রামের আশরাফুল আলম বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে আমাদের রানীনগর গ্রামটি কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনের শিকার, অনেক পরিবারের বাড়িঘর ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। আমাদের গ্রামের ১৫টি বাড়ি যেকোনো সময় ভাঙ্গনের শিকার হবে।’
বাগময়না গ্রামের আল আমিন ইসলাম বলেন, ‘আমাদের গ্রামে নদীর ভাঙ্গন বন্ধ করার জন্য একবছর ধরে ব্লক তৈরি করা হচ্ছে, এখনো কাজ শুরু হয়নি।’
পাকা সড়ক নদী ভাঙ্গনের পর থেকে বিলিশ্রী গ্রামের গুলজার মিয়ার বাড়ির পুকুর পাড় দিয়ে ৭টি গ্রামের জনসাধারণ যাতায়াত করেন। বর্তমানে পুকুর পাড়টিও নদী ভাঙ্গনের সম্মুখীন হয়েছে। এতে যেকোনো সময় রৌয়াইল রানীগঞ্জ খেয়াঘাট সড়ক পথে যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
বালিশ্রী গ্রামের আশরাফুল হক বলেন, ‘আমাদের গ্রামের চলাচলের একমাত্র সড়কটি কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে। বর্তমানে গুলজার মিয়ার পুকুর পাড় দিয়ে আমাদের প্রায় ৭টি গ্রামের মানুষ যানবাহন সহ যাতায়াত করছেন। বর্তমানে পুকুরপাড় নদী ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে, হয়তো ১০দিন এই স্থান দিয়ে আমরা যাতায়াত করতে পারবো এরচেয়ে বেশিদিন টিকবে না।’
জগন্নাথপুর উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ইরফানুল ইসলাম বলেন, ‘ফেছীবাজার, ভাঙ্গাবাড়ি ও বাগময়না কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গণ কবলিত এলাকায় নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের ব্লক তৈরি হচ্ছে, বন্যা ও নদীর পানি বেশি থাকায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না, চলতি বছরের ডিসেম্বরে অথবা আগামী জানুয়ারি মাস থেকে তীর সংরক্ষণ কাজ শুরু হবে।’
নদী ভাঙ্গন ও তীর সংরক্ষণ বিষয়ে জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল বশিরুল ইসলাম বলেন, ‘ফেছীবাজার, ভাঙ্গা বাড়ি সহ ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় ব্লক তৈরি হচ্ছে। নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, এজন্য নতুন এলাকায়ও ভাঙ্গণ শুরু হয়েছে। নদী খনন করা প্রয়োজন। এজন্য বর্তমান সরকারের সময়ে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে আলোচনা করে প্রদক্ষেপ নেওয়া হবে। রাস্তাঘাট বসতবাড়ি রক্ষায় কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গণ রোধে সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য এলাকার ভুক্তভোগী জনসাধারণ দাবী জানিয়েছেন।’