চা শিল্পে নতুন সংকট

সম্ভাবনা থাকার পরও এবারও দেশে চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০০ মিলিয়ন কেজিতে পৌঁছাতে পারছে না। ইতোমধ্যে আবার নতুন করে শ্রমিক মজুরি, গ্যাস, ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে বাগানগুলোর চা উৎপাদন নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা জানান, অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পরও কয়েক বছর ধরে একশ মিলিয়ন কেজি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাগান শ্রমিক-মালিক ও কর্মকর্তারা স্বপ্ন দেখছিলেন। নানা কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে টানা ২২ দিনের আন্দোলনে সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। এবার নতুন করে যোগ হচ্ছে আরেক সংকট শ্রমিক মজুরি, গ্যাস, ডিজেলের দাম।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, শ্রমিক মজুরি, গ্যাস, ডিজেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়েছে, এখন বাগানগুলোর উৎপাদন কীভাবে টিকে থাকবে চিন্তায় আছি।

তারা বলেন, তিন বছর ধরে দেশের চা-শিল্প কঠিন সময় চললেও সব কিছুর পরও পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চা-শ্রমিকরা উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখেন। বিশেষ করে মহামারি করোনা প্রাদুর্ভাব কমতে না কমতেই, এ বছর রেকর্ড ভঙ্গ করা বৃষ্টি ও ভয়াবহ বন্যা চা-উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায়। কিন্তু ২২ দিনের শ্রমিক আন্দোলন সকল অর্জনকে ম্লান করে পেছনে ফেলে দেয়,’ এই মন্তব্য করে একাধিক চা-বাগান কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুবা এই বছরই আমরা একশত মিলিয়ন কেজির বেশি চা-উৎপাদন করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করতে পারতাম।

তারা বলেন, এবার মৌসুমের প্রথম দিকে ও অক্টোবর মাসে আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি শ্রমিক আন্দোলনের কারণে। বাগান পরিচর্যা ও ‘পাতি’ তোলার ভরা মৌসুম আগস্ট মাস। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনের সময় চায়ের ‘কুড়ি’ বের হয়ে লম্বা হয়ে আগাছায় পরিণত হয়।

হাবিবনগর চা-বাগানের ব্যবস্থাপক হুমায়ূন কবির জানান, এবার তাদের বাগানে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার কেজি। কিন্তু সাড়ে চার লাখ কেজি হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তিনি।

সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ১৬৭টি চা-বাগান রয়েছে। এছাড়া পঞ্চগড়-লালমনিরহাটে ক্ষুদ্রায়তনের চা-বাগান রয়েছে। সারা বাংলাদেশে এই খাতে মোট তিন লক্ষাধিক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের অনেকটা চাহিদা মিটিয়ে থাকে দেশের উৎপাদিত চা।

এদিকে, সাধারণত নভেম্বর মাসে চা-পাতি তোলার কাজ শেষ করে। ডিসেম্বরে চা-গাছ প্রুনিং (ছেঁটে দেয়া) করা হয় এবং নতুন বছরেরর জন্য গাছগুলোকে প্রস্তুত করতে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগে। পরে ফেব্রুয়ারি-মার্চের বৃষ্টিতে নতুন কুড়ি বের হয়। এবার অক্টোবরে ভালো বৃষ্টি হওয়ায় পাতি তোলার কাজ একেবারে শেষ হয়নি। তাই প্রুনিং কিছুটা দেরি হচ্ছে।

নর্থ সিলেট ভ্যালি ও বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নোমান হায়দার চৌধুরী বলেন, এবার শ্রমিক আন্দোলনে সময়মত ‘পাতি’ তুলতে না পারা ও যথাযথ বাগান পরিচর্যার অভাবে ১শত মিলিয়ন কেজি চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় না পৌঁছার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া এবার চায়ের কোয়ালিটিও কিছুটা খারাপ হয়েছে, চা-গাছ লম্বা হয়ে যায় বলে। তাই নিলাম বাজারে প্রতি কেজি চা ২০০ টাকার ওপরে উঠেনি। তবে সিন্ডিকেট করে সেই চা ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রয় হচ্ছে ৪০০ টাকায়।

তিনি বলেন, চা উৎপাদনকারী যদি তার পণ্যের দাম না পান তাহলে তারা এই শিল্প টিকেয়ে রাখতে আগ্রহ হারাবেন।

চা সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে মোট চায়ের উৎপাদনের পরিমাপ এখনো পাওয়া যায়নি। ডিসেম্বরেই পাওয়া যাবে। গত বছর দেশে ৯৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। এবার অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৯৩ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়েছে পঞ্চগড়ের চায়ের উৎপাদন নিয়ে।

তবে তারা বলছেন, পঞ্চগড়ের চায়ের গুণগত মান সিলেট বা চট্টগ্রামের চায়ের মতো নয়। তারা বলেন, পরিমাপ কিছুটা বেশি হলেও মানসম্মত চায়ের উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নয়।

২০১৬ সালে দেশে চা উৎপাদনের রেকর্ড ভঙ্গ করে পরবর্তীতে ২০১৯ সালে ৯ কোটি কেজি চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। তখন দেশে ১০০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের স্বপ্ন দেখেন চা সংশ্লিষ্টরা। তবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।

২০২১ সালে দেশের ১৬৭টি চা-বাগান থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৭৭ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন কেজি ধরা হয়। স্বপ্ন দেখেন ১০০ মিলিয়ন কেজি চা পাতা উৎপাদনের। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় চা-বাগানের সার্বিক কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল। ১০০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের আশা করে ৯৬ মিলিয়ন কেজি উৎপন্ন হয়।

সূত্র : ইত্তেফাক