‘ও দুশমন ওখল রে, আমার ঘর না ভাইঙ্গা আমারে মাইরা ফালাইলে না ক্যানে রে। এখন আমার বউ-বাচ্চাসহ এতজন মানুষ নিয়া কই থাকমু রে। আমার বাবার রাখি যাওয়া শেষ স্মৃতিখান ইলা শেষ করলে ক্যানে রে’। এভাবেই প্রতিপক্ষের দ্বারা বসতঘর হারিয়ে ভিটায় বসে মাথায় হাত রেখে বিলাপ করছিলেন ইস্তফা মিয়া।
দুই পুরুষ আগের বসতঘর। এই বসত ঘরেই জন্মলগ্ন থেকে বসবাস বাংলাদেশ পুলিশের এক সদস্য রুবেল আহমদসহ ৬ ভাইয়ের। বড়ভাই আলকাব মিয়া, ইস্তফা মিয়া, লিটন মিয়াসহ ছয় ভাইয়ের এখন পৃথক পরিবার। তবে সকলেই বসবাস করছেন একই চালের নিচে। সব পরিবারের প্রায় ২০ জন লোকের বসবাস এই বসত ঘরে। তাদের বাবা মরহুম আঞ্জব আলীর রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতি বলতে এই বসত ঘর ছাড়া আর কিছুই নেই।
শনিবার (০২ নভেম্বর) সকাল ৭টায় সদলবলে দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্রের মুখে বসতঘরটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্রতিপক্ষ রাজন মিয়া, জয়নাল মিয়াসহ ৩০/৪০ জন লোক। ন্যাক্কারজনক এই ঘটনাটি ঘটেছে শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের দূর্বাকান্দা গ্রামের পূর্ব পাড়ায়।
রুবেল আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য হওয়ায় তিনি থাকেন তার কর্মস্থল সিলেট হাইওয়ে থানায়। বর্তমানেও তিনি সেখানে অবস্থান করছেন। তার অপর পাঁচ ভাই জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছিলেন। এই সুযোগে সকালে ত্রিশ চল্লিশজনের একটি দল নিয়ে এসে সমস্ত বসতঘর গুঁড়িয়ে দিয়ে আসবাবপত্রসহ অন্যান্য মালপত্র নদীর পাড়ে নিয়ে রেখেছেন প্রতিপক্ষের লোকজন। খবর পেয়ে তারা নিজ বাড়িতে এসে এমন দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বসতঘর হারিয়ে মাটিতে পড়ে আহাজারি করছিলেস নারী-পুরুষসহ পরিবারটির অন্যান্য সদস্যরা। তাদের কান্নায় পাড়াপ্রতিবেশিরাও কেঁদেছেন।
শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দুর্গম দূর্বাকান্দা গ্রামে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পুলিশ সদস্য রুবেল আহমদ ও ইস্তফা মিয়াদের বসত ভিটায় কোনো ঘর নেই। ভিটাটি খালি পড়ে আছে। হঠাৎ কেউ দেখলে ভাববেন ঘুর্ণিঝড়ে গুড়িয়ে নদীর পাড়ে নিয়ে ফেলেছে। কোথাও পালঙ্ক, কোথাও ফ্রিজ, কোথাও বাসনপত্র। একটি বাঁশের খুঁটিও খাড়া নেই। বাড়ির পেছন দিকে ফেলে দেওয়া হয়েছে কিছু আর নদীর পাড়ে কিছু। বড় বড় বাঁশ বেঁধে সীমানা দিয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা। এসব দেখে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন বসত ঘরে থাকা শিশু, বৃদ্ধ লোকজন। পাড়াপ্রতিবেশি মুখ খুলে কিছু না বললেও হায় হায় করছেন। বলছেন, এভাবে ভেঙে ফেলা ঠিক হয়নি।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, আমাদের বাড়ি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঝামেলা চলছে। রাজন মিয়া, জয়নাল ও সাহেব আলীরা দাবি করছে এই বসতভিটা তাদের। এসব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তারা মাতামাতি করে আসছে। তারা নাকি আমাদের বাড়ি পায়। আমরা বলেছি, যদি এই বাড়ি কাগজে পত্রে তারা পায় আর কোর্টে রায় দেয় আমরা এখান থেকে চলে যাবো। একদিনও থাকবো না। কিন্তু তারা চাচ্ছে কোর্টের রায়টায় নাই, এখনই আমরা যেনো জায়গাটা ছেড়ে দেই। আইন-আদালত রেখে কেনো তাদের কথামতো বাড়ি ছাড়ছি না এটাই আমাদের অপরাধ। কেনো পুলিশে যাই, কোর্টে যাই এটা তারা মানতে চায় না। জোর করে আমাদের উচ্ছেদ করে দিতেই ঘরবাড়ি ভেঙে ভিটা খালি করেছে। আমরা পুরুষ মানুষ কেউ বাড়িতে ছিলাম না। আমাদের মহিলাদেরও তারা লাঞ্চিত করেছে৷ নগদ চার লক্ষ টাকাসহ স্বর্ণালঙ্কার, রুপার অলঙ্কারসহ অনেক কাগজপত্রও তারা নিয়ে গেছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে রামদাসহ দাঁড়ালো অস্ত্র ছিলো। কেউ বের হলে একটা মার্ডার হতে পারতো। রাজন একজন কু-প্রবৃত্তির লোক। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলাসহ দশটিরও বেশি মামলা আছে।
প্রত্যক্ষদর্শী শাকিরা বেগম বলেন, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আমি সবজি কাটছিলাম। হঠাৎ আমার নাতি চিৎকার দিয়ে বলে লাঠিসোটা নিয়ে এই বাড়ির দিকে অনেক লোক আসছে। তারপর তারা ইস্তফা মিয়াদের বাড়িতে থাকা শিশু ও মহিলাদের বের করে দিয়ে ‘ফিল্মি স্টাইলে’ বাড়িঘর ভেঙে আসবাবপত্র, টিন, ফ্রিজসহ সবকিছু নদীর পাড়ে নিয়েছে। মহিলাদের লাঞ্চিত করেছে। আমরা কথা বলতে চেয়েছিলাম, রামদা দেখিয়ে আমাদের হুমকি দিয়েছে। বলেছে, কেউ ভিডিও করতে গেলে তার মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া হবে। এটা একদম অন্যায়। এমন কাজ এই এলাকায় আর ঘটেনি। মনে হচ্ছে দেশে আইন কানুন বলতে কিছুই নেই। হামলায় এই গ্রামের প্রভাবশালী রাজন মিয়া, জয়নাল মিয়া, শাহ আলম, সালাম মিয়া, জুলহাস মিয়া, শাহাব উদ্দিন, এরশাদ মিয়া, আলী হোসেন, আবদুল মুত্তালিব, সাহেব আলী, কুদ্দুস মিয়া, জুয়েল আহমদ, আল আমীন, বিলাল আহমদ, কামাল আহমদ, জামাল আহমদ, হেলাল আহমদসহ প্রায় ৩৫ জন লোক জড়িত ছিলো।
ভুক্তভোগী ইস্তফা মিয়া ও লিটন মিয়া বলেন, আমরা বাড়িতে ছিলাম না। আমাদের ঘরে হামলা করে, ভাঙচুর করে নগদ চারলক্ষ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে গেছে। সবকিছু দূরে ফেলে রাখছে। এসব করেও তারা কান্ত হয়নি। এখন তারা আমাদের হুমকি দিচ্ছে। পুলিশ ও সাংবাদিক চলে গেলে আমাদের উপর হামলা করবে, এই জায়গায় তারা ঘর তুলতে আসবে, দখল করতে আসবে। এমতাবস্থায় আমরা খুবই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আদালতের মাধ্যমে তারা যদি জায়গা পায় আমরা ছেড়ে দেবো। অন্যত্র চলে যাবো কিন্তু বে আইনী ভাবে তারা আমাদের বসতঘর ভাঙার ও লুটপাটের বিচার চাই।
অভিযুক্ত সকলের সাথে কথা বলার সুযোগ না হলেও প্রধান অভিযুক্ত রাজন মিয়া ও জায়গার মালিক দাবিকারী সাহেব আলীর স্ত্রী হুরে মদিনার সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। রাজন মিয়া বলেন, ‘ইস্তফা মিয়ারা যে জায়গায় বসবাস করছেন এটি তাদের জায়গা নয়। তাদের জায়গা আরো পশ্চিমে। কিন্তু জোরজবর দখল করে তারা এখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে। গ্রামের পঞ্চায়েতের সকলে তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দিতে বলেছেন। আগামী ফাল্গুন মাসে তারা জায়গা ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিলো। এর আগে তারা থানা, পুলিশ, কোর্টে গিয়ে আরো প্যাঁচ লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। এখন আমরা নিরুপায় হয়ে, আমি বাড়িতে ছিলাম না, সকাল শুনি ছেলেপুলেরা মিলে তাদের ঘর ভেঙে দিয়েছে। এটা ঠিক হয়নি। তাদের লোকজনকে মারধর করা হয়নি, মালপত্রও কেউ নষ্ট করেনি। শুধু ঘর ভেঙেছে এটা ঠিক। কেউ যদি বলেন যে এই জায়গায় আমরা অবৈধভাবে আছি তাহলে যে শাস্তি দেওয়া হবে তা মাথা পেতে নেবো।
হুরে মদিনা বলেন, ‘এই জায়গার মালিক আমার স্বামী। পঞ্চায়েতের লোকজন জায়গা ছাড়ার জন্য ৯ মাস সময় দিয়েছিলো। কিন্তু তার আগেই তারা আমাদের লোকদের উপরে মামলা দিয়েছে। এজন্য তারা (আমাদের লোকজন) গেছে, গিয়ে তারা তাদের বাড়ি ভেঙ্গে দিয়ে জায়গা দখল নিয়েছে।’
খবর পেয়ে এসআই সোলায়মানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিলো। অভিযুক্তদের বাড়িতে তল্লাশি করে কাউকেই পায়নি তারা। সোলায়মান জানান, আগে থেকেই এই জায়গার উপরে একটি ১৪৪ ধারার মামলা রুজু করা আছে।
শান্তিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকরাম আলী বলেন, ‘বাড়ির জমি সংক্রান্ত ঝামেলার জেরে এই ঘটনা ঘটেছে। যারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন আদালত অবমাননার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। ঘরবাড়ি ভাঙচুর করায় ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মামলা করলে কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’