বঙ্গবন্ধু টানেলের ৯০ শতাংশ কাজ শেষ

খুলছে যোগাযোগের আরেক দিগন্ত

পদ্মা সেতুর পর এবার দৃশ্যমান হয়েছে দেশের প্রথম কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে জোরেশোরে। টানেলের কাজের পাশাপাশি দুই পাশের সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজ এগিয়ে নিচ্ছে সড়ক ও জনপথ এবং সেতু বিভাগ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী অক্টোবরে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বঙ্গবন্ধু টানেল।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৯০ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। টানেল চালু হলে দৈনিক ১৭ হাজার ২৬০ এবং বছরে ৭৬ লাখ যানবাহন চলাচল করতে পারবে। টানেল ঘিরে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ বলেন, ‘বুধবার পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ৯০ দশমিক ৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আরও ৯ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ বাকি আছে। আমরা চেষ্টা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার। তবে কাজ শেষ করতে কত সময় লাগবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। প্রকল্পের মেয়াদ আছে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যেই আমরা কাজ শেষ করতে পারবো বলে আশা রাখছি।’

বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু টানেলের একটি টিউব অক্টোবরে আরেকটি টিউব নভেম্বরে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সচিবালয়ের গণমাধ্যমকেন্দ্রে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে এ তথ্য জানান মন্ত্রী।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নগরের পতেঙ্গা নেভাল একাডেমির পাশঘেঁষে শুরু হয়ে কর্ণফুলী নদীর মাঝ দিয়ে দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তে উঠেছে। চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে টানেল। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে টানেল অবস্থান করবে ১৫০ ফুট গভীরে। টানেলের নির্মাণকাজ করছে চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নে ২৭০ চীনা নাগরিক এবং এক হাজার ১৫২ জন বাংলাদেশি দিনরাত কাজ করছেন।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল অক্টোবরের যেকোনো দিন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা চলছে। টানেলে যান চলাচলের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নে নতুন মাইলফলক রচিত হবে। সমৃদ্ধ হবে অর্থনীতি। বাড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার। জাতীয় অর্থনীতিতে টানেল অবদান রাখবে। টানেল চালু হলে যাতায়াতের সময় বাঁচবে। এতে জ্বালানি ও অর্থের সাশ্রয় হবে।’

তিনি বলেন, ‘টানেলের সড়ক একসময় এশিয়ান হাইওয়ের অংশ হয়ে দাঁড়াবে। এমন মহাপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। কিছুদিন পর সমুদ্রের পাড়ে বে-টার্মিনাল চালু হবে। সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মযজ্ঞ হবে। মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল পুরোদমে চালু হলে লাখ লাখ মানুষ সেখানে থাকবে; যার প্রভাব নগরীতে পড়বে। টানেলের অপর প্রান্তে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড, চীনা শিল্পাঞ্চল, মহেশখালীর মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ চট্টগ্রামে চলমান মেগা প্রকল্পগুলো চালু হলে বাড়বে জনসমাগম। সেইসঙ্গে বাড়বে যানবাহনের চাপ। এসব কারণে নগরীকে নতুনভাবে সাজানোর কাজ চলছে।’

সিডিএ’র এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘টানেল চালু হলে নগরীতে যানবাহনের চাপ আরও বাড়বে। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছে। শুধুমাত্র টানেলের কথা মাথায় রেখে নগরীর সড়ক নেটওয়ার্কে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখানে যানবাহন ওঠানামার জন্য বাড়ানো হচ্ছে ইউলুপ এবং আন্ডারপাস। টানেল চালু হওয়ার পর শহরের যানজটের চাপ সামাল দিতে আপাতত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে নিমতলা পর্যন্ত আট কিলোমিটারের কাজ দ্রুত শেষ করে টানেল চালুর আগেই খুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে চীনের সহায়তা পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ২ শতাংশ হারে এ ঋণ দিয়েছে। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

দুটি টিউব সংবলিত নদীর তলদেশে মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যাসার্ধ ১০ দশমিক ৮০ মিটার। টানেলটি দুটি টিউবে চার লেনবিশিষ্ট। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক এবং ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজ।

২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী অক্টোবরে যান চলাচলের জন্য টানেলটি খুলে দিতে চাচ্ছে সরকার।

টানেল প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করবে চীনা কোম্পানি। গত ১৮ মে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এ কাজের জন্য চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে নিয়োগের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন