ক্রিকেটের ‘ফেইক ফিল্ডিং’ নাকি মিথ্যা অজুহাত

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ভারতের কাছে পাঁচ রানে পরাজয়ের পর ফেইক ফিল্ডিং নিয়ে তোলপাড় গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কেউ বিরাট কোহলির মুন্ডুপাত করছেন, কেউ আইসিসির দরবারে নালিশ করার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। এমনকি অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সঙ্গে থাকা বিসিবি পরিচালক জালাল ইউনুসও সেখানে দেশীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন এই নিয়ে যথাযথ ‘ফোরামে’ আলাপ করা হবে।

এসব ব্যাপারে দেশ রূপান্তর খতিয়ে দেখেছে ক্রিকেটের আইন কী বলে, কথা বলেছে বাংলাদেশের একজন আন্তর্জাতিক ম্যাচ রেফারির সঙ্গে।

ক্রিকেটের আইনের পরিভাষায় ‘ফেইক ফিল্ডিং’ বলে আসলে কিছু নেই। ক্রিকেটের আইনপ্রণেতা মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব বা এমসিসি’র ক্রিকেট আইনের ধারা ৪১ এর ৫ হচ্ছে, ‘ডেলিবারেট ডিসট্র্যাকশন, ডিসেপশন অর অবস্ট্রাকশন অফ ব্যাটার’ অর্থাৎ ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাটারকে বাধা দেওয়া, (ব্যাটারের) মনোযোগ অন্যদিকে সরানো অথবা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেওয়া। এই ধারাটি আবার ৪১ এর ৪ এর সঙ্গেও সংযুক্ত, যাতে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যাটার যখন ডেলিভারি খেলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সেই সময়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মনোযোগ নষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে বলে দুই আম্পায়ার যদি একমত হন তাহলে সেই বলটা ডেড বল ঘোষণা করা যেতে পারে এবং ব্যাটিং দলের রানের সঙ্গে ৫ রান জরিমানা যোগ করা যেতে পারে।’ এবারে আসা যাক ৪১ এর ৫ ধারায়। এখানে বলা হয়েছে, ‘৪১ এর ৪ এর সঙ্গে আরও যোগ করা হয়েছে, কোনো ফিল্ডারের জন্যই স্বেচ্ছায় কথায় বা কাজে বা শব্দের মাধ্যমে বাধাদান, মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটানো কিংবা ছলচাতুরী হবে অন্যায্য। সেটা যে কোনো ব্যাটারকেই, ডেলিভারি গ্রহণের পরেও।’

এই ধারায় ২য় ও ৩য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মাঠের আম্পায়ারদ্বয় বা একজন আম্পায়ার, তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন খেলায় এমন কোনো বিঘ্ন হয়েছে কি না। যদি একজন মনে করেন, তাহলে অন্য আম্পায়ারকে জানাবেন। বোলিং প্রান্তে আম্পায়ার নো বল বা ওয়াইডের সংকেত দেবেন এবং প্রযুক্ত ক্ষেত্রে ৫ রান জরিমানা করবেন।’

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংসের সপ্তম ওভারে ঘটে একটি ঘটনা। অক্ষর প্যাটেলের বলে অফ সাইডে বেশ দূরেই বল পাঠিয়ে রান নিচ্ছিলেন লিটন দাস ও নাজমুল হোসেন শান্ত। বল কুড়িয়ে উইকেটরক্ষক দীনেশ কার্তিকের কাছে ফেরত পাঠান আর্শদীপ সিং। বলটা বিরাট কোহলির মাথা ঘেঁষে যাওয়ার সময় বল ছুড়ে মারার ভঙ্গি করেন পয়েন্টে দাঁড়ানো কোহলি। ততক্ষণে দুই ব্যাটসম্যান প্রান্ত বদল করেছেন। ম্যাচশেষে অ্যাডিলেইড ওভালের মিক্সড জোনে সহ-অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান সাংবাদিকদের জানান, ম্যাচে বাংলাদেশ ৫ রান জরিমানা পেতে পারত। উল্লেখ্য, সোহানের একটি আচরণে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫ রান জরিমানা দিয়েছিল বাংলাদেশ। কুইন্টন ডি কক স্ট্রাইক নেওয়ার সময় উইকেটের পেছনে নড়াচড়া করায় সোহানের জন্য ৫ রান বাড়তি যোগ হয় দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহে। তবে সেদিন বাংলাদেশ ১০৪ রানে হেরে যাওয়াতে সোহানের এই ‘অপরাধ’ চাপা পড়ে যায়।

এসব নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল বাংলাদেশের একজন সাবেক ক্রিকেটারের সঙ্গে, যিনি ম্যাচ রেফারি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেছেন। সংগত কারণেই তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তার অভিমত, ‘দিনশেষে বাংলাদেশ ৫ রানে হেরেছে এবং এই রকম অপরাধের ক্ষেত্রে ৫ রান জরিমানার বিধান আছে বলেই এত কথা হচ্ছে। দেখুন ঘটনাটা যখন হয়, তখন বাংলাদেশ ম্যাচে চালকের আসনে। তখন কিন্তু এসব নিয়ে কথা হয়নি, হচ্ছে ৫ রানে হারার পর। আম্পায়ারদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, এসব ঠিক না। এই সংস্কৃতিটা উপমহাদেশেই বেশি। আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তকে সম্মান করা খেলারই অংশ।’ ম্যাচ রেফারি হিসেবে কাজ করা সাবেক এই ক্রিকেটার আরও জানান, ‘ম্যাচ রেফারি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করবেন, নিজের প্রতিবেদনে যদি এই নিয়ে কিছু লেখার থাকে লিখবেন। আম্পায়ারদেরও তো মার্কিং হয়।’ বিসিবি পরিচালকের যথাযথ ফোরামে এই প্রসঙ্গ তোলা নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আসলে একটা ম্যাচ হয়ে গেলে এই নিয়ে আর কোথাও কোনো কিছু বলার সুযোগ নেই। ২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে একটা ওভার থ্রো যে ব্যাটে লেগে চার হলো, সেটাও ভুল আইনে হয়েছে। কিন্তু খেলার ফল নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, এখন এসব নিয়ে আর কোথাও কিছু বলার নেই। হয়তো আইসিসির আম্পায়ার্স কমিটির বৈঠক বা প্রধান নির্বাহীদের বৈঠকে কীভাবে আরও সুচারুভাবে খেলা পরিচালনা করা যায় সেসব ব্যাপারে এই প্রসঙ্গ আলোচনায় উঠতে পারে।’

বুধবার অ্যাডিলেইডে খেলা বৃষ্টিতে বন্ধ ছিল ৫২ মিনিট। তখন কেউ এই কথিত ‘ফেইক ফিল্ডিং’ দেখেনি। টেলিভিশনে সরাসরি দেখানো হচ্ছে খেলা, প্রেস বক্সে ৬০ জনের বেশি বাংলাদেশি সাংবাদিক কেউ এসব দেখেননি। কেউ এই নিয়ে টুঁ শব্দও করেননি। যেই ম্যাচ শেষে নুরুল হাসান বললেন, অমনি ঝাঁপিয়ে পড়া! হতে পারে নুরুল হাসানের কাণ্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ম্যাচে ৫ রান জরিমানা দেওয়ায় আইনটা নিয়ে তার জানা ছিল, এজন্যই মাঝের ৫২ মিনিটে এই নিয়ে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ তুলে অতি আবেগে ফের খেলা শুরুর পর ভুলভাল শট খেলে আউট হয়েছেন ক্রিকেটাররা। অথবা এমনটাও হতে পারে, শেষ পর্যন্ত উইকেটে থেকেও দলকে জেতাতে না পারার আক্ষেপেই নুরুল হাসানের অমন বক্তব্য। যে বক্তব্যের পর চাপা পড়ে গেছে বাংলাদেশের মিডল অর্ডারের ব্যাটিং ব্যর্থতা, খরুচে বোলিং। ম্যাচ হারের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে সেই ৫ রান!

সৌজন্যে : দেশ রূপান্তর